মঙ্গলবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৪:০৬ পূর্বাহ্ন
সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে অমানবিক নির্যাতনে রায়হান আহমদ (৩৪) হত্যার তিন বছর পূর্ণ হচ্ছে বৃহস্পতিবার (১১ অক্টোবর)। দেশে-বিদেশে আলোচিত এ মামলাটি বর্তমানে সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রমের শেষের দিকে রয়েছে।
২০২০ সালের ১০ অক্টোবর দিনগত মধ্যরাতে নগরের কাষ্টঘর এলাকা থেকে রায়হান আহমদকে ধরে নিয়ে যায় সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) কোতোয়ালি থানার বন্দরবাজার ফাঁড়ির পুলিশ। সেখানে নিয়ে রায়হানকে অমানবিক নির্যাতন করে তার হাতের নখ উপড়ে ফেলা হয়। পরদিন (১১ অক্টোবর) সকালে তিনি মারা যান। এ ঘটনার পর পুলিশ প্রথমে রায়হানকে ‘ছিনতাইকারী’ সাজিয়ে গণপিটুনিতে মারা যাওয়ার নাটক সাজায়। পরে তার পরিবার ও এলাকার লোকজন তা প্রত্যাখ্যান করে তাকে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ এনে সড়ক অবরোধ, অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের গ্রেফতার ও কঠোর শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ করেন। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনেও রায়হানের প্রতি পুলিশের নির্মমতার বিষয়টি ফুটে ওঠে। রায়হানের শরীরের বিভিন্ন স্থানে ১১১টি আঘাতের চিহ্ন পান চিকিৎসকরা।
এ ঘটনায় পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে রায়হানের স্ত্রী তামান্না বাদী হয়ে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির অজ্ঞাতপরিচয় পুলিশ সদস্যদের আসামি করে কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা করেন।
মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, পুলিশের নির্যাতনেই রায়হানের মৃত্যু হয়েছে। মামলার তিন বছর পর সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পথে। এরই মধ্যে মামলার মোট ৬৯ জন সাক্ষীর মধ্যে ৫৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে।
তবে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর আগে মামলা আপস করতে আসামিরা ৫০ লাখ টাকার লোভ দেখান রায়হানের পরিবারকে। এমনই অভিযোগ করেছেন তার মা সালমা বেগম।
নিহত রায়হান আহমদের মা সালমা বেগম বলেন, “রায়হানের মৃত্যুর মাত্র ১৫ মাস আগে বিয়ে হয়। রায়হান মারা যাওয়ার দুই মাস আগে তার একমাত্র মেয়ে আলফা আক্তারের জন্ম হয়। নাতনি আলফার বয়স এখন তিন বছর দুই মাস। মেয়েটি বাবার আদর ছাড়াই বড় হচ্ছে। সে কোনোদিন ‘বাবা’ ডাকতে পারবে না। এমন চিন্তা মাথায় এলে ঘুম আসে না।’
সালমা বেগম আরও বলেন, আসামি ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়ার লোকজন সাক্ষ্যগ্রহণের আগে মামলা আপস করতে ৫০ লাখ টাকার লোভ দেখিয়েছে। তবে আমরা সেই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছি। ছেলে হত্যার ন্যায়বিচার পাবেন এমন প্রত্যাশা করে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি চান তিনি।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর মধ্যরাতে সিলেট মহানগর পুলিশের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে রায়হান আহমদকে নির্মম নির্যাতন করা হয়। ১১ অক্টোবর তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় ওইদিন রাতেই পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে মামলা করেন রায়হানের স্ত্রী। পরে মহানগর পুলিশের একটি অনুসন্ধান কমিটি তদন্ত করে। তারা ফাঁড়িতে নিয়ে রায়হানকে নির্যাতনের সত্যতা পায়। এ ঘটনায় ফাঁড়ির ইনচার্জের দায়িত্বে থাকা এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ চারজনকে ১২ অক্টোবর সাময়িক বরখাস্ত ও তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়। এরপর পুলিশি হেফাজত থেকে কনস্টেবল হারুনসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এসআই আকবরকে ৯ নভেম্বর সিলেটের কানাইঘাটে ভারতীয় সীমান্ত থেকে গ্রেফতার করা হয়।
২০২১ সালের ৫ মে আলোচিত এ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয় পিবিআই। অভিযোগপত্রে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ওইসময়ে ইনচার্জের দায়িত্বে থাকা এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে (৩২) প্রধান অভিযুক্ত করা হয়। অন্যরা হলেন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আশেক এলাহী (৪৩), কনস্টেবল হারুন অর রশিদ (৩২), টিটু চন্দ্র দাস (৩৮), ঘটনার সময় ফাঁড়ির টু-আইসি সাময়িক বরখাস্তকৃত এসআই হাসান উদ্দিন (৩২) ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সংবাদকর্মী আবদুল্লাহ আল নোমান (৩২)।
এদের মধ্যে হাসান ও নোমানের বিরুদ্ধে মামলার আলামত নষ্ট করার অভিযোগ আনা হয়েছে। গতবছরের ১৮ এপ্রিল অভিযোগ গঠনের মধ্যদিয়ে মামলার বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, মামলার ৬৯ জন সাক্ষীর মধ্যে রায়হানের মা সালমা বেগম ও স্ত্রী তাহমিনা আক্তার সাক্ষ্য দিয়েছেন। গত ৭ সেপ্টেম্বর মামলায় সবশেষ সাক্ষ্য দিয়েছেন সিলেট মেট্রোপলিটন চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৩ এর বিচারক শারমিন খানম। ১২ অক্টোবর সাক্ষ্য দেওয়ার কথা রয়েছে সিলেট মেট্রোপলিটন চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দ্বিতীয় আদালতের বিচারক সাইফুর রহমানের। এছাড়া পরবর্তী সময়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করা পিবিআই পরিদর্শক আওলাদ হোসেন, মুহিদুল ইসলাম, সিলেট কোতোয়ালি থানার সাবেক এসআই আবদুল বাতেন এবং সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকের সাক্ষ্য দেওয়ার কথা রয়েছে।
মামলায় অভিযুক্ত এক পুলিশ সদস্য উচ্চ আদালতের নির্দেশে জামিনে রয়েছেন। তবে মামলায় একমাত্র অভিযুক্ত আসামি সংবাদকর্মী আবদুল্লাহ আল নোমান বিদেশে পালিয়ে গেছেন। বাকি চার আসামি কারাগারে রয়েছেন। আবদুল্লাহ আল নোমানের বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও মালামাল ক্রোকের আদেশ তামিল করেছে পুলিশ।
এদিকে মামলার প্রধান অভিযুক্ত সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া তার আইনজীবীর মাধ্যমে গত ১০ সেপ্টেম্বর ব্যক্তিগত অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে আদালতে হাজিরা থেকে অব্যাহতির আবেদন করেছেন।
রায়হান হত্যা মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম এ ফজল চৌধুরী বলেন, মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ শেষের দিকে রয়েছে। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে যুক্তিতর্ক ও আসামি পরীক্ষা শেষ করে রায় ঘোষণা করা হবে। আশা করছি, বিচারপ্রক্রিয়া শেষে অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে।