BD SYLHET NEWS
সিলেটরবিবার, ২১শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, সকাল ১১:২৫
আজকের সর্বশেষ সবখবর

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে সন্ত্রাসী হামলা: গণমাধ্যমের ইতিহাসে লজ্জার এক অধ্যায়


ডিসেম্বর ২০, ২০২৫ ৬:৪৭ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

বাংলাদেশের গণমাধ্যম ইতিহাসে এক ভয়াবহ ও নজিরবিহীন দিন পার করল দেশের দুই শীর্ষ সংবাদপত্র প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার। বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) রাতভর ঢাকা শহরের কেন্দ্রে পরিকল্পিত সন্ত্রাসী হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে দুই পত্রিকাকে কার্যত পঙ্গু করে দেওয়া হয়। স্বনামধন্য এই দুটি সংবাদমাধ্যমের ওপর একযোগে আক্রমণ বাংলাদেশের সংবাদ স্বাধীনতার ওপর গুরুতর আঘাত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

রাত সাড়ে ১১টার দিকে শাহবাগ থেকে ৩০–৩৫ জনের একটি দল মিছিল করে কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো ভবনের সামনে আসে। প্রথমে তারা ‘অবরোধ কর্মসূচি’ নামে অবস্থান নিলেও দ্রুতই স্লোগান ও উসকানির মধ্য দিয়ে সহিংসতায় রূপ নেয়। রাত ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে তারা ভবনের গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে, অফিস সরঞ্জাম ভাঙচুর করে এবং পরে নথিপত্রের স্তূপে আগুন ধরিয়ে দেয়।

কিছু পুলিশ কর্মকর্তা উপস্থিত থাকলেও পর্যাপ্ত প্রতিক্রিয়া না থাকায় হামলাকারীরা নির্বিঘ্নে তাদের কাজ চালিয়ে যায়। রাত আড়াইটার দিকে সেনাবাহিনী, র‍্যাব ও বিজিবি সেখানে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে তার আগে ভবনের তিনটি তলা সম্পূর্ণ পুড়ে যায় এবং দুটি ফায়ার সার্ভিস কর্মী আহত হন।

একই সময়ে শাহবাগ দিক থেকে আরেকটি দল কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ের ডেইলি স্টার ভবনে হামলা চালায়। নিচতলা থেকে শুরু করে সাততলায় উঠে সবকিছু ভাঙচুর করে ও অগ্নিসংযোগ ঘটায়। ভবনের অভ্যন্তরে ২৮ জন সাংবাদিক ও কর্মী আটকে পড়ে ছাদে আশ্রয় নেন। অনেকে অজ্ঞান হয়ে পড়েন মারাত্মক ধোঁয়ায়।

সকাল সাড়ে চারটার দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রচেষ্টায় তাঁদের উদ্ধার করা হলে দেখা যায়, ভবনের নিচ থেকে দোতলা পর্যন্ত সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে।

ঢাকার বাইরে কুষ্টিয়া, খুলনা ও সিলেটের প্রথম আলোর আঞ্চলিক কার্যালয়ে হামলা হয়েছে; চট্টগ্রাম, বগুড়া ও বরিশালে হামলার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এই হামলাগুলোও একধরনের “সমন্বিত তৎপরতা”র ইঙ্গিত দেয়, যা পরিকল্পিত সংগঠিত আক্রমণের প্রমাণ বহন করে।

ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রাথমিক হিসাবে শত কোটি টাকাকে ছাড়িয়েছে। ধ্বংস হয়েছে দুটি পত্রিকার ডেটা সেন্টার, প্রিন্টিং ম্যাটেরিয়াল, এমনকি চরকি ওটিটি প্ল্যাটফর্মও। সাংবাদিক ও কর্মীরা নিজেরা কোনোভাবে প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষতিগ্রস্ত দুই সম্পাদকের সঙ্গে ফোনে কথা বলে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন এবং বলেন, “এই ন্যক্কারজনক ঘটনায় সরকার সংবাদকর্মীদের পাশে থাকবে।”

আন্তর্জাতিকভাবে বিবিসি, রয়টার্স, এএফপি, এপি, আল–জাজিরা, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) ও মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশনসহ বিভিন্ন সংস্থা এই হামলাকে সংবাদ স্বাধীনতার প্রতি আঘাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। দেশে সম্পাদক পরিষদ, নোয়াব, টিআইবি, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, সাংবাদিক ইউনিয়ন, জাতীয় প্রেসক্লাবসহ প্রায় সব সাংবাদিক সংগঠন ও নাগরিক সমাজ কঠোর নিন্দা জানায়।

বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, সিপিবি, গণসংহতি আন্দোলন ও এবি পার্টি রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দোষীদের দ্রুত বিচার দাবি করে।

ঘটনায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় শহীদ ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকে পুঁজি করে স্বার্থান্বেষী একটি গোষ্ঠী এই অপতৎপরতা চালিয়েছে। তাদের লক্ষ্য ছিল স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠ স্তব্ধ করা এবং আগামী নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।

এই দৃষ্টিতে ঘটনাটি কেবল ভবন বা অর্থনৈতিক ক্ষতির নয়—এটি রাজনৈতিকভাবে গণমাধ্যমকে ভীত করার প্রচেষ্টা, যা সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে সরাসরি হুমকির মুখে ফেলেছে।

এই হামলা বাংলাদেশের সংবাদস্বাধীনতার জন্য এক ভয়াবহ বার্তা বহন করে। দৃশ্যত কয়েক ঘণ্টার সহিংস ঘটনায় ধ্বংস হয়েছে বহু বছরের পরিশ্রম, কিন্তু তার চেয়েও বড় ক্ষতি হয়েছে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও মনোবলে। দীর্ঘদিন ধরে চাপ সহ্য করা পত্রিকা দুটি—যারা সরকারের ও রাজনৈতিক শক্তির সমালোচনায় অটল থেকেছে—তাদের ওপর এই সহিংসতা স্বাধীন মতপ্রকাশের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে।

এ ঘটনায় প্রমাণ হয়, প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মধ্যেই পুষ্টি পাচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত উগ্রতা। গণমাধ্যমের প্রতি আস্থা ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি।

দুই পত্রিকার প্রিন্ট সংস্করণ একদিন বন্ধ থাকলেও অনলাইন সংস্করণ আংশিকভাবে চালু হয়েছে। কর্মীরা ক্ষয়ক্ষতির মধ্যেও নতুন করে কাজ শুরু করেছেন। ডেইলি স্টার জানায়, “আমরা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পথ থেকে সরে যাব না।” একইভাবে প্রথম আলো সম্পাদক জানান, “এটি একটি কালো দিন, কিন্তু গণতন্ত্রের প্রতি দায়িত্ব থেকে আমাদের থামানো যাবে না।”

এই হামলা শুধুমাত্র দুইটি অফিস ধ্বংসের ঘটনা নয়; এটি স্বাধীন সাংবাদিকতার অস্তিত্বের ওপর আঘাত। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলতে থাকলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কাগজে–কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আজ “প্রথম আলো” আর “ডেইলি স্টার” আক্রান্ত—কাল সেই আগুন যেকোনো সত্যবক্তার মুখে পৌঁছাতে পারে।

লেখক,মনজুর এহসান চৌধুরী সাংবাদিক, কলামিস্ট।

 

কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।