BD SYLHET NEWS
সিলেটশনিবার, ৮ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, রাত ১১:২২
আজকের সর্বশেষ সবখবর

স্ত্রীর ভালোবাসার লিভারে নতুন জীবন পেলেন স্বামী


নভেম্বর ৮, ২০২৫ ৯:২৬ অপরাহ্ণ
Link Copied!

অপারেশনের পর দিল্লির ম্যাক্স সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের সামনে স্বামী আলম নুরীর সঙ্গে খাদিজা খাতুন
ভালোবাসা কেবল একটি শব্দ নয়, এটি এক কঠিন বাস্তবতা। আস্থা আর চরম সংকটেও একে অপরের পাশে থাকার এক নিঃশর্ত অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকারেরই এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) সাবেক শিক্ষিকা খাদিজা খাতুন (৩৪)। স্বামী মোহাম্মদ আলম নুরীর (৩৬) নিভে যেতে বসা জীবন প্রদীপকে ফের জ্বালিয়ে তুলতে তিনি নিজের লিভারের ৬৪ শতাংশ প্রদান করেছেন স্বামীর শরীরে। এটি শুধু একটি অঙ্গদানের গল্প নয়, এটি এক বছরের রুদ্ধশ্বাস লড়াই, পাহাড়সম বাধা অতিক্রম এবং অগণিত মানুষের নিঃস্বার্থ সহযোগিতায় বোনা যেন এক মহাকাব্য।

খাদিজা খাতুনের বাড়ি রাজশাহী শহরে। মোহাম্মদ আলম নুরীর বাড়ি বান্দরবানের লামায়। বর্তমানে তারা রাজধানীর মিরপুরে বসবাস করেন। এই দম্পতির সংসারে কেএম আরিয়ান (৮) ও কেএম আদনান (৬) নামে দুটি ছেলে রয়েছে। আরিয়ান নার্সারি দ্বিতীয় শ্রেণিতে এবং আদনান নার্সারিতে পড়ে।

গল্পের শুরু যেভাবে
২০১১ সালে আশুলিয়ায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের (বিএনসিসি) সেন্ট্রাল ট্রেনিং এক্সারসাইজ (সিটিই) ক্যাম্পে মোহাম্মদ আলম নুরী ও খাদিজা খাতুনের পরিচয়। সারাদেশের বিএনসিসির তিন উইংয়ের ক্যাডেটদের নিয়ে ছিল এই ক্যাম্প। ওই সময় বিএনসিসির নেভাল উইংয়ের ক্যাডেট সার্জেন্ট ছিলেন আলম নুরী, আর মহাস্থান রেজিমেন্টের ক্যাডেট আন্ডার অফিসার (সিইউও) ছিলেন খাদিজা। সেই পরিচয় থেকে পরিণয়। ২০১২ সালে পারিবারিকভাবে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

ওই সময় আলম নুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের চতুর্থ বর্ষে এবং খাদিজা খাতুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। এরপর পড়াশোনা শেষ করে আলম নুরী রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে ব্র‍্যাকে যোগদান করেন। পরে কনসালটেন্ট হিসেবে এনজেন্ডারহেলথ বাংলাদেশে চাকরি করেন। খাদিজা ২০১৫ সালে বিইউপিতে আইন বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর তাদের সংসারে ২০১৭ সালের জুলাইয়ে প্রথম সন্তান কেএম আরিয়ানের জন্ম হয়। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে জন্ম হয় দ্বিতীয় সন্তান কেএম আদনানের। ২০২০ সালের নভেম্বরে বিইউপি থেকে চাকরি ছাড়েন খাদিজা। দুই সন্তানকে নিয়ে তাদের সংসার ছিল সুখের এক ছোট্ট নীড়।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস। সুখের সেই নীড়ে হঠাৎই আঘাত হানে এক বিধ্বংসী ঝড়। বেশ কিছুদিন ধরেই জ্বরে ভুগছিলেন আলম। এর কয়েকমাস আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্লাটিলেট কমে যাওয়ায় শরীর বেশ দুর্বল ছিল। ১২ সেপ্টেম্বর রাতে হঠাৎ করেই তিনি রক্তবমি শুরু করেন। অবস্থার অবনতি হলে পরিবারের সদস্যরা তাকে নিয়ে ছুটে যান সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালসহ রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে। কিন্তু রক্তবমি না থামায় চিকিৎসকরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করেন।

সেখানে রাত ১০টায় ভর্তির কিছুক্ষণ পরই আলম জ্ঞান হারান। তাকে দ্রুত আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। চিকিৎসকদের প্রাণান্তকর চেষ্টায় প্রায় ৯ ব্যাগ রক্ত ও প্লাটিলেট দেওয়ার পর তার রক্তপাত বন্ধ হয়। এরপর শুরু হয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। অবশেষে জানা যায় এক দুঃসংবাদ- আলম হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসজনিত লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত এবং রোগটি পৌঁছে গেছে শেষপর্যায়ে। রোগের নাম-নন অ্যালকোহলিক লিভার ডিজিস (এনএএলডি)। গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি বিভাগে স্থানান্তরের পর চিকিৎসকরা পরিষ্কার জানিয়ে দেন এর একমাত্র স্থায়ী চিকিৎসা লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট। যা বাংলাদেশে তখনো সহজলভ্য ছিল না এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এই রোগের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা। যিনি অসুস্থতার কারণে বেকার তার পক্ষে এই ব্যয় বহন করা ছিল প্রায় অসম্ভব।

এটা আমার দয়ার কোনো দান নয়। আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ যে তিনি আমাকে উনার (স্বামী) বেঁচে থাকার উসিলা হিসেবে কবুল করেছেন। আমার স্বামীর মনোবল, মানসিক দৃঢ়তা এবং মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ছিল অগাধ। তিনি কখনোই ভেঙে পড়েননি। তার সাহস আমাকে মানসিক শক্তি যুগিয়েছে।

খাদিজা খাতুন
এরপর খাদিজার শুরু হয় এক কঠিন লড়াই। একদিকে স্বামীর জীবন বাঁচানোর জন্য চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া, অন্যদিকে ভারতে ট্রান্সপ্ল্যান্টের জন্য ভিসা প্রসেসিং এবং বিপুল অর্থ জোগাড়। ওই সময়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফায়েজ আহমেদ খন্দকার, ঢাকা মেডিকেলের ডা. জিয়া, পিজি হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. বিধান চন্দ্র এবং শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের ডা. ফারুক আহমেদের মতো চিকিৎসকদের আন্তরিক সহযোগিতা ও সঠিক নির্দেশনা তাদের পথ দেখিয়েছে।

তবে দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে ভারতের মেডিকেল ভিসা পেতে ছয় মাস সময় লেগে যায়। এই দীর্ঘ প্রতীক্ষা আলম-খাদিজার মানসিক যন্ত্রণাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। যখন সব পথ প্রায় বন্ধ, তখন ভালোবাসার শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসেন তাদের পরিবার, স্বজন, বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীরা। চিকিৎসার বিপুল ব্যয় নির্বাহের জন্য তারা আর্থিক সহায়তা করেন।

ভারতে যাত্রা ও নতুন চ্যালেঞ্জ

অবশেষে পর্যাপ্ত অর্থ সংস্থান এবং ভিসা পাওয়ার পর ২০২৫ সালের মার্চে ভারতের দিল্লির ম্যাক্স সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেন আলম-খাদিজা দম্পতি। বিশ্বখ্যাত লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জন ডা. সুভাষ গুপ্তার অধীনে চিকিৎসার সিদ্ধান্ত হয়। খাদিজার রক্তের গ্রুপ ‘ও’ পজিটিভ হওয়ায় তিনি ডোনার হিসেবে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হন। কিন্তু ভারতে গিয়েও শুরু হয় নতুন চ্যালেঞ্জ। ডিএনএ ম্যাচিংয়ের জন্য দেশে থাকা সন্তানদের রক্তের নমুনা আনা, অসংখ্য আইনি কার্যক্রম ( যেমন- এনআইডি, জন্মনিবন্ধন, ম্যারেজ সার্টিফিকেট) অ্যাপোস্টাইল করে হাইকমিশনের এনওসি সংগ্রহ করা এবং খাদিজার ভিসা অ্যাটেনডেন্ট থেকে মেডিকেলে পরিবর্তন করা-প্রতিটি ধাপ ছিল সময়সাপেক্ষ ও জটিল। তবে বিহারের বাংলাভাষী ইনজামামুল কাইফ এবং সারদা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাইকার মতো মানুষের নিঃস্বার্থ সহযোগিতা তাদের এই কঠিন সময়কে সহজ করে দেয়। সকল আইনি প্রক্রিয়া শেষে মেডিকেল বোর্ড তাদের ট্রান্সপ্ল্যান্টের অনুমতি দেয়। গত ৭ আগস্ট ডা. সুভাষ গুপ্তা এবং তার দল সফল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে খাদিজার লিভারের ৬৪ শতাংশ তার স্বামীর শরীরে প্রতিস্থাপন করে।

অস্ত্রোপচারের প্রস্তুতি ও পরবর্তী অবস্থা

৬ আগস্ট দিল্লির ম্যাক্স হাসপাতালে সারারাত প্রস্তুতি, ওষুধ ও ইঞ্জেকশন চলতে থাকে। এর আগে ৪ আগস্ট আলমকে এবং খাদিজাকে ৬ আগস্ট সেখানে ভর্তি করা। দুজনের প্রি-অ্যানেস্থেশিয়া চেকআপ ও কনসালটেশন (সার্জারি রিস্ক সম্পর্কে অবগত করা) ও মেন্টাল চেকআপ সম্পন্ন হয়। ৭ আগস্ট দুজনকে গোসল, ক্যানোলা ও অন্যান্য প্রস্তুতি শেষে রাত সাড়ে ৩টায় নিয়ে যাওয়া হয় অপারেশন থিয়েটারে। সেখানেই তারা ফজরের নামাজ আদায় করেন। ভোর ৪টায় অজ্ঞান করা হয়। খাদিজার অপারেশন সম্পন্ন হয় দুপুর সোয়া ১টার দিকে, জ্ঞান ফেরে দুপুর ২টায়। সব কিছু ঠিক থাকা সাপেক্ষে বিকেল ৩টায় আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। খাদিজাকে জানানো হয় তার স্বামীর অপারেশন সফলভাবে হচ্ছে।

আলমের অপারেশন শেষ হয় বিকেল সাড়ে ৫টায়। এরপর রাতেই আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয় এবং জ্ঞান ফিরে ৮ আগস্ট রাত আড়াইটার দিকে। তখন আজান দিয়ে আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করেন আলম। এরপর আইসিইউতে ১৫ দিন সুক্ষ্ম অবজারভেশন ও নিবিড় পরিচর্যা শেষে অবস্থা কিছুটা ভালো হলে আলমকে বেডে শিফট করা হয়। খাদিজাকে ৫দিন আইসিইউতে রেখে ডিসচার্জ দেওয়া হয়। আলমকে ডিসচার্জ দেওয়া হয় মোট ২১ দিন পর। এরপর প্রথমে প্রতি তিন দিন পরপর টেস্ট করে রিপোর্টসহ ডাক্তার ভিজিট করতে হয়, পরে প্রতি সপ্তাহে এক বার এভাবে আরও দুই মাস হাসপাতালের বাইরে থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওষুধের মাত্রা কম-বেশি করা হয়। কিছুটা সুস্থ অনুভব হলে দেশে আসার অনুমতি দেওয়া হয় এবং স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে পুনরায় কাউন্সিলিং করা হয়। ২ অক্টোবর দেশে ফেরেন এই দম্পতি। তবে লড়াই এখনো শেষ হয়নি। আলম নুরীকে আজীবন কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ খেতে হবে এবং কঠোর নিয়ম মেনে চলতে হবে। এখন প্রতি মাসে ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য খরচ হয় প্রায় ৪০ হাজার টাকা।

এখন দুই ছেলেকে নিয়ে গল্প করি, তাদের খেলাধুলা দেখি, একসাথে খাই, এসব এখনো আমার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে। একটা ঘোরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এ জীবন আমার নয়, আমার বলতে কিছুই নেই। আমার ভেতরের কলিজাটিও আমার স্ত্রীর।

খাদিজার স্বামী আলম নুরী
এর আগে ম্যাক্স হাসপাতালে ট্রান্সপ্ল্যান্টের জন্য ২১ লাখ রুপি, যা ডালারে পেমেন্ট করে ভর্তি হতে হয়। এর বাইরে ট্রান্সপ্ল্যান্ট পূর্ববর্তী চিকিৎসা, থাকা খাওয়া, ডকুমেন্টস প্রস্তুত করা, যাতায়াত, পরবর্তী ইনভেস্টিগেশন এবং ওষুধপত্র বাবদ আরও প্রায় ১৫-২০ লাখ রুপি প্রয়োজন এই ধরনের রোগীর জন্য।

খাদিজা খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সর্বপ্রথম মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করি। আল্লাহর ইচ্ছা ও সকলের দোয়া এবং আন্তরিক সহযোগিতা না পেলে এ যাত্রা প্রায় অসম্ভব ছিল। অনেকেরই ডোনার থাকলেও টাকার অভাবে চিকিৎসা সম্পন্ন করতে পারেন না, আবার অনেকেই অরগান দিতে চাইলেও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় শেষ পর্যন্ত রিজেক্ট হয়ে যান। তাই সব কিছুই মহান আল্লাহর ইচ্ছা ও অশেষ দয়া, তিনিই উত্তম পরিকল্পনাকারী। এটা আমার দয়ার কোনো দান নয়। আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ যে তিনি আমাকে উনার (স্বামী) বেঁচে থাকার উসিলা হিসেবে কবুল করেছেন। আমার স্বামীর মনোবল, মানসিক দৃঢ়তা এবং মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ছিল অগাধ। তিনি কখনোই ভেঙে পড়েননি। তার সাহস আমাকে মানসিক শক্তি যুগিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, গত একবছর আমাদের কোনো আয় নেই, শুধু ব্যয়ের খাতা খোলা রয়েছে। আমাদের পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে, কাজে-কর্মে ফিরতে আরও দুই থেকে ছয় মাস সময় লাগবে। নতুন করে কী করব, কীভাবে চলবে জানি না, শুধু মহান আল্লাহর ওপর ভরসা রাখি তিনি হায়াত ও সুস্থতার যেমন মালিক রিজিকের ব্যবস্থাও তিনি নিশ্চয়ই করে রেখেছেন। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া পরবর্তী চিকিৎসা ও জীবনযাপনের ব্যয় বহন আমাদের পক্ষে অসম্ভব। আশা রাখি আগামীর পথচলাতেও বন্ধু, আত্নীয়-স্বজন ও বড় ভাইয়েরা পাশে থাকবেন। দোয়ায় রাখবেন।

যারা পাশে ছিলেন তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে খাদিজা বলেন, এই জীবন এত এত মানুষের ভালোবাসা ও অবদানে সিক্ত যে এক জীবনে তাদের ঋণ শোধ করা সম্ভব নয়। এই এক বছরে সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টা, সহমর্মিতার কথা স্মরণ করলেই কৃতজ্ঞতায় চোখ ভিজে যায়। এই সুখ স্মৃতি সারাজীবনের পাথেয়। আমি সবাইকে জনে জনে হয়তো জানাতে পারব না, যারা নীরবে নিঃস্বার্থভাবে পাশে থেকেছেন এবং এখনো আছেন তারাই প্রকৃত বীর। তাদের মানবতার কাছে হার মেনেছে মৃত্যু।

খাদিজার স্বামী মোহাম্মদ আলম নুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই নশ্বর পৃথিবীতে আমার জন্মদিন দুইটা। একটা ঐশ্বরিক অন্যটা পার্থিব। প্রথমটাতে আমার মা ও বাবার অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়। দ্বিতীয়টিতে আমার স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, বড় ভাই, আমার এবং আমার স্ত্রীর স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী-অনুজ-অগ্রজ, প্রফেশনাল পরিচিতজন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট ও অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠন এবং দেশ-বিদেশের নাম না জানা অপরিচিত অনেক শুভাকাঙকীর দোয়া ও অবদান অনস্বীকার্য। সকলের প্রার্থনা ও সহযোগিতার কারণেই সম্ভবত মহান আল্লাহ আমার অবুঝ দুই ছেলেকে পিতৃহারা করেননি। অসীম ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ তায়ালার কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া।

জটিল এই রোগের চিকিৎসার বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের দেশের কোনো চিকিৎসকই সরাসরি আমাকে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার পরামর্শ দেননি আইনি জটিলতার কারণে। তবে প্রতিবার ডাক্তারের কাছে গেলেই আমার স্ত্রী এবং আমার ভাইকে দেখতাম কান্না করতে করতে ডাক্তারের রুম থেকে বের হতে। এতে আমি কিছুটা অসহায়ত্ব অনুভব করতাম। তবে আশা ছিল হয়তো কোনোভাবে দেশের বাইরে গেলেই আল্লাহ একটা উসিলা ঠিকই পাইয়ে দেবেন। খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে এর ম্যাচিং জটিলতা রয়েছে এবং বেশ কিছু ভুল তথ্য পাই যা আমার মানসিক শক্তি আরও ভেঙে দেয়। আবার অন্যদিকে আর্থিক দিকটা ভাবিয়ে তুলছিল। তবুও আমার মহীয়সী স্ত্রীর অফুরন্ত আশান্বিত চক্ষু অবলোকনের পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম দেশের বাইরে একবার গিয়ে দেখি।

আলম বলেন, আমার আত্মীয়-স্বজনদের চোখে চরম হতাশা দেখেছি, অন্যদিকে স্ত্রীর চোখে দেখি আশার প্রদীপ। এরই মাঝে দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে ভিসা জটিলতায় পড়ি। মাস ছয়েক পর ভারত ভ্রমণের ভিসা পাই। দিল্লি ও হায়দ্রাবাদের বেশ কয়েকটি হাসপাতালের নামকরা লিভার বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন একমাত্র লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টই শেষ চিকিৎসা। সেই দিন আমি অসহায় হয়ে পড়ি। আকাশহীন ভাবা স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে অসম্ভব কেঁদেছিলাম। আমার স্ত্রী আমাকে বলেছিল- ‘শেষ চেষ্টা করেই দেখি।’ ও আমাকে লিভার দান করবে বলে সাহস যোগায়। কিন্তু আমার ধারণা ছিল শুধু নিজ রক্তের গ্রুপের ছাড়া অন্য কারও লিভার ম্যাচ হবে না। পরে ডাক্তার জানান আমার স্ত্রী সর্বজনীন দাতা রক্তের গ্রুপের অধিকারী হওয়ায় তার লিভারের অংশ আমার শরীরে ম্যাচ করবে। তবুও আমার স্ত্রীর শারীরিক ঝুঁকি ও সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এই পরিকল্পনা থেকে আমি মনে মনে সরে আসি। দেশে এসে ছেলেদের মুখের দিকে তাকিয়ে এবং আমার স্ত্রীর অসহায় চেহারা ও কাকুতিতে রাজি হই। বাঁচা মরা দুজনেই আল্লাহ তায়ালার ওপর ছেড়ে দিয়ে নিজেদের সপে দিয়েছিলাম।

তিনি বলেন, লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টের পর আইসিইউতে আমার জ্ঞান ফেরার দুই দিন পর থেকে আমাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করতে থাকে। যেহেতু আমাকে একটি ১৩ ঘণ্টার সার্জারির ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে তাতে শরীরের রক্ত- প্রোটিন ও অন্যান্য খনিজের স্বল্পতা তৈরি হয়ে ছিল। ডাক্তাররা চাচ্ছিলেন আমি যেন মেডিসিনের ওপর নির্ভর না করে খাবার থেকেই এসবের ঘাটতি পূরণ করি। কিন্তু মুখের স্বাদ এবং রান্নার ভিন্নতা আমাকে বিষিয়ে তোলে এবং এর ফলে শারীরিকভাবে দুর্বল হতে থাকি। এই অবস্থা দেখে আমার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী নিজের পেটের সেলাইয়ের তোয়াক্কা না করে হাসপাতালের বাইরে রুম নিয়ে আমার জন্য মশলা ছাড়া খাবার রান্না করে আইসিইউতে প্রতিদিন দুবেলা করে নিয়ে এসে নিজ হাতে খাইয়েছে। এরপর প্রোটিনের ঘাটতি কিছুটা পূরণ হলে আমাকে আইসিইউ থেকে বের করে ওয়াডে শিফট করে। একদিকে সেও রোগী যে মাত্র ৪-৫ দিন আগেই একটা ৬ ঘণ্টার অপারেশন থেকে উঠেছে। অন্যদিকে আমারও রুচি ফেরাতে ঘরোয়া খাবার দরকার। এই এক মহাসংকটে নিজের জীবনকে আবারও তুচ্ছ করে আমার সেবায় নেমে পড়েছিল। এখনো জানি না কি এমন সংকল্পের কারণে এত ত্যাগ তার, কী এমন ছিল আমাদের ভালোবাসায়। যেহেতু আমাদের প্রকৃত কোনো অ্যাটেনডেন্ট ছিল না, তাই খুবই দুরুহ সময় গিয়েছে সার্জারি পরবর্তী সময়ে।

আলম বলেন, ২০২৫ সালের ৭ আগস্টের পরের জীবন আমার স্ত্রী ও পাশে থাকা মহামানবদের। আমার কাছের কিছু বড় ভাই, বন্ধুদের এত বেশী অবদান ছিল এখন তাদের সামনে বসে কথা বলতে নিজেকে অপরাধী লাগে। মনে হয় তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা আমার জন্য ফেরেশতার রুপে পাঠিয়েছেন। এখন দুই ছেলেকে নিয়ে গল্প করি, তাদের খেলাধুলা দেখি, একসাথে খাই, এসব এখনো আমার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে। একটা ঘোরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এ জীবন আমার নয়, আমার বলতে কিছুই নেই। আমার ভেতরের কলিজাটিও আমার স্ত্রীর।

তিনি বলেন, এই চিকিৎসার জন্য দরকার প্রচুর সাহস। অপরিসীম সাহস না থাকলে এ পথ পাড়ি দেওয়া অসম্ভব। আমি এখন এক নতুন স্বাভাবিকত্বের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এই স্বাভাবিকত্ব সতর্কতার, নিয়মনীতির, অস্বাভাবিক দামি ওষুধ সেবনের, সকল ঝামেলা এড়িয়ে চিন্তাহীন জীবন যাপনের।

কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।