বিডি সিলেট ডেস্ক:: নিউ ইয়র্কের কুইন্স কাউন্টি সুপ্রিম কোর্টের ভবনে নতুন এক অধ্যায় রচিত হলো এক নারী বিচারপতির শপথে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নারী বিচারপতি। তাঁর নাম সোমা সাইদ। শপথক্ষণের নিস্তব্ধতা যেন তরঙ্গে ভেঙে পড়েছিল করতালির ঢেউয়ে, যেখানে পরিবারের গর্ব এবং অভিবাসী স্বপ্নের দীর্ঘ যাত্রা এক বিন্দুতে এসে মিলেছিল।
সোমা সাইদের শিকড় বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলায়। বাবা ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট, মা ছিলেন প্রধান শিক্ষিকা। ন্যায়বোধ, শৃঙ্খলা আর দায়িত্ববোধে গড়া সেই পারিবারিক শিক্ষাই তাঁর চরিত্রের ভিত গড়ে দেয়। বারো বছর বয়সে তিনি পাড়ি দেন যুক্তরাষ্ট্রে। নতুন দেশ, নতুন ভাষা, নতুন সমাজ সবকিছু ছিল অচেনা, কিন্তু তাঁর লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট। নিউ ইয়র্ক সিটির পাবলিক স্কুলে পড়াশোনা শেষে তিনি সিটি কলেজ অব নিউ ইয়র্ক থেকে স্নাতক এবং অ্যালবানি ল স্কুল থেকে জ্যুরিস ডক্টর (J.D.) ডিগ্রি অর্জন করেন।
প্রায় দুই দশক ধরে তিনি কুইন্সে আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁর legal practice ছিল সাধারণ মানুষ ও অভিবাসীদের পাশে দাঁড়ানোর এক প্রচেষ্টা। Civil, family, immigration—বিভিন্ন ধরনের আইনি বিষয়ে তিনি সেবা দিয়েছেন ন্যায়বিচার-বঞ্চিত মানুষদের। এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই তিনি বুঝেছিলেন, আইন শুধু ধারায় লেখা নিয়ম নয়, এটি মানবিকতার এক রূপ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির ভেতর থেকেও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা এই বিশ্বাসই তাঁকে এগিয়ে নিয়েছে বিচারকের আসনের দিকে।
২০২১ সালের নির্বাচনে তিনি কুইন্স কাউন্টি সিভিল কোর্টের বিচারক নির্বাচিত হন। ১ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে তিনি বিচারক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এটি ছিল অভিবাসী বাঙালি সমাজের জন্য এক ঐতিহাসিক অর্জন। সেই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালের নভেম্বরে তিনি নিউ ইয়র্ক স্টেট সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নির্বাচিত হন বিপুল ভোটে।
আদালতের বাইরেও সোমা সাইদের কাজ সমানভাবে সক্রিয়। তিনি কুইন্স কাউন্টি উইমেনস বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম দক্ষিণ এশীয় নারী সভাপতি ছিলেন, এবং নিউ ইয়র্ক সিটি Equal Justice Implementation Committee-এর কুইন্স শাখার কো-চেয়ার হিসেবে সব মানুষের জন্য ন্যায় নিশ্চিত করা নিয়ে কাজ করেছেন। মহামারির অস্থির সময়ে তিনি কমিউনিটির পাশে দাঁড়িয়েছেন, মাস্ক ও খাদ্য সহায়তা উদ্যোগ সংগঠিত করেছেন। তাঁর কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে, বিচারকের দায়িত্ব কেবল আদালতের দেয়ালে সীমাবদ্ধ নয়, এটি সমাজ ও মানুষের প্রতিও এক অঙ্গীকার।
তাঁর স্বামী মিজান চৌধুরী, যিনি মৌলভীবাজারের সন্তান, দীর্ঘদিন ধরে নিউ ইয়র্কে আইটি বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক কৌশলবিদ হিসেবে পরিচিত। এই দম্পতি তাঁদের পরিবার, পেশা ও সামাজিক দায়িত্বকে একই স্রোতে মিলিয়ে দিয়েছেন।
সোমা সাইদের এই অর্জন কেবল একজন নারীর জয় নয়, এটি এক জাতির প্রতিচ্ছবি। এটি প্রমাণ করে, অভিবাসনের গল্প কেবল বেঁচে থাকার গল্প নয়, বরং উঠে দাঁড়ানোরও গল্প। টাঙ্গাইলের ছোট্ট শহর থেকে নিউ ইয়র্কের আদালত কক্ষ, এই দীর্ঘ পথচলা প্রজন্মকে শেখায়, দৃঢ়তা থাকলে ইতিহাসের দরজা একসময় খুলেই যায়। এটি সারা বিশ্বের প্রতিটি মেয়ে শিশুর জন্য এক আশার প্রদীপ, যে শিশুটি হয়তো এখনই কোথাও বসে বইয়ের পাতায় স্বপ্ন লিখছে: “একদিন আমিও ন্যায়বিচারের চেয়ারে বসব।”
