মো. শফিকুল ইসলাম :: বিএনপির জন্য অত্যন্ত সুসময় ছিল ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত। সেই সময়ে দলে ছিল অনেক নেতার ভিড়। কিন্তু ২০০৭ সালে এক-এগারোর সরকার ক্ষমতায় আসার পর দলটির অবস্থা আস্তে আস্তে খারাপের দিকে যায়। এর পর থেকেই দলটির প্রভাবশালী কিছু নেতা বিএনপির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। এই নেতারা ‘সংস্কারপন্থি’ বলে পরিচিতি লাভ করেন। এরপর শেখ হাসিনার ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হলে বিএনপির জন্য আরও কঠিন দুঃসময় আসে। ঠিক সেই সময়ে, বিশেষ করে শেখ হাসিনার শাসনের শেষ ১০ বছরে দলটির প্রভাবশালী অনেক নেতা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। তাদের কেউ কেউ স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে নির্বাসনে যান; আবার কেউবা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে গোপনে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে হাত মেলান। এদের বাইরে কেউ কেউ শেখ হাসিনার সঙ্গে গোপন সমঝোতা করে টিকে থাকার চেষ্টাও করেন। কেউবা আবার নতুন দল গঠন করে নির্বাচনে অংশ নেন।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে এক নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ, দেশে নেই শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের অধিকাংশ নেতা। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির দুঃসময়ে দল ছেড়ে বিদেশে চলে যাওয়া নেতারা দেশে ফিরতে শুরু করেছেন। পাশাপাশি দেশে অবস্থান করা নেতারা চেষ্টা করছেন দলে ফিরতে। এসব নেতা কে কোথায় আছেন, তা নিয়ে জনমনে কৌতূহল রয়েছে।বাংলাদেশ ভ্রমণ
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দল ছেড়ে যাওয়া এই নেতাদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে পুনর্বাসিত হয়েছেন। আবার অনেকে দেশে ফিরে এলেও এখনো দলে কোনো পদ পাননি। তবে এসব নেতা বিএনপিতে ফেরার জন্য ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য মির্জা আব্বাস এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘দলের অনেক বহিষ্কৃত ও পদত্যাগ করা নেতা গণসংযোগ করছেন। কিন্তু তাদের দলে ফেরানোর ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত আছে কি না আমার জানা নেই।’
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘বিএনপির হাইকমান্ড তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। হাইকমান্ড যে সিদ্ধান্ত দেয়, আমরা তা বাস্তবায়ন করি।’
বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের একাধিক নেতা-কর্মী বলছেন, দলের কঠিন সময়ে বিত্তশালী ও প্রভাবশালী নেতাদের যখন প্রয়োজন ছিল, তখনই তারা দল থেকে পদত্যাগ করেন। আর এখন সুসময়ে তারা দলে ফিরছেন, পদ-পদবি পাওয়ারও চেষ্টা করছেন- এমন রাজনীতির চর্চা ভালো নয়। কারণ স্পষ্টতই দলের প্রতি তাদের কমিটমেন্টের অভাব রয়েছে।
বিএনপির একসময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা ছিলেন মোসাদ্দেক আলী ফালু। তিনি দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ছাড়াও ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব। বিএনপির ডাকসাইটে একজন ব্যবসায়ী ও খালেদা জিয়ার অত্যন্ত আস্থাভাজন ছিলেন মোসাদ্দেক আলী। কেউ কেউ বলছেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে সালাহউদ্দিন আহমদের নাম থাকা এবং নিজের নাম ভাইস চেয়ারম্যান পদে দেখে ক্ষোভ ও অভিমানে দল থেকে পদত্যাগ করেন ফালু। তার পদত্যাগপত্র বিএনপি গ্রহণও করেনি আবার ফেরতও পাঠায়নি। ২০১৭ সালে তিনি দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমান। সাত বছর পর ২০২৪ সালের ১৯ আগস্ট বিদেশ থেকে দেশে ফেরেন তিনি। ফিরেই তিনি বিমানবন্দর থেকে সরাসরি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি মামলা থেকে তিনি খালাস পেয়েছেন। তবে দলে ফিরে আসার আনুষ্ঠানিক কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
অনেকের মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তার ব্যবসায়িক কার্যক্রম ঠিক রাখা এবং কিছুটা নির্বিঘ্নে থাকার জন্যই বিএনপি থেকে দূরে ছিলেন মোসাদ্দেক আলী। এখন আবারও বিএনপিতে ফেরার চেষ্টা করছেন। ফালু খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেও ঠিক আগের মতো আর জায়গা পাচ্ছেন না বলে বিএনপিতে আলোচনা আছে। তবে সব পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা এখনো ফালুকে বিএনপির লোক হিসেবেই জানেন। সদালাপী এবং ভালো আচার-ব্যবহারের জন্য ফালুর সুনাম রয়েছে।
ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে ২০১৯ সালের ৬ নভেম্বর দল থেকে পদত্যাগ করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও জিয়া পরিবারের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক একসময়ের ডাকসাইটে ব্যবসায়ী নেতা এম. মোরশেদ খান। তিনি প্যাসিফিক গ্রুপের চেয়ারম্যান। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এবং ২০০২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন।
জানা যায়, ২০১৮ সালের নির্বাচনে তাকে মনোনয়নবঞ্চিত করা হয়। পরবর্তী সময়ে দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় চট্টগ্রাম কমিটিতে তার অনুসারীদের পদ না দেওয়ায় অভিমানে রাজনীতি থেকে তিনি অবসর নেন। বর্তমানে মোরশেদ খান ও তার পরিবার সিঙ্গাপুরে বসবাস করছেন। সেখানেই তার ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে। নেতা-কর্মীরা বলছেন, ব্যক্তিগত কারণ দেখালেও মোরশেদ খান মূলত তার ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য শেখ হাসিনা সরকারের রোষানল থেকে বাঁচতে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেন। অবশ্য বয়সের ভারে ন্যুব্জ এবং এখন অনেকটাই অসুস্থ বিএনপির সাবেক এই নেতা।
ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর (বীর উত্তম) বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যদের মধ্যে একজন এবং শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন বাকেরগঞ্জ-১২ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে ঝালকাঠি-১ আসনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে জয়লাভ করেন। খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায় প্রতিমন্ত্রী ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন মেজর (অব.) ওমর। বিএনপির কঠিন দুঃসময়ে দীর্ঘ ৪৫ বছরের সম্পর্কের ইতি টেনে ২০২৩ সালের ৩০ নভেম্বর আওয়ামী লীগে যোগ দেন শাহজাহান ওমর। পদচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে তাকে ফোন করে ২০২৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অনুরোধ করেন বলে ওই সময়ে গণমাধ্যমে তিনি স্বীকার করেন। তবে আওয়ামী লীগে যোগদানের দিনই তাকে বহিষ্কার করে বিএনপি। ওই সময় নৌকা প্রতীকের পক্ষে ‘গুনগান’ করে তিনি আলোচিত হন।
প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকেই ঝালকাঠি-১ আসনে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ৬ আগস্ট সংসদ ভেঙে দেয় রাষ্ট্রপতি। সংসদ সদস্য পদ হারিয়ে তিনি একূল-ওকূল দুই কূলই হারিয়েছেন। এরপর শাহজাহান ওমর প্রায় চার মাস পলাতক ছিলেন। গত বছরের ২১ নভেম্বর তাকে আদাবর থানায় হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে আইনশঙ্খলা বাহিনী। সেই থেকেই কারাগারে আছেন তিনি। তার ছেলে আদনান ওমর ও মেয়ে মেহজাবিন সাচ্চি। দুজনই ঢাকায় থাকেন। আদনান ওমর ব্যবসা করেন। পরিবারের সদস্যরা নিয়মিত কারাগারে গিয়ে শাহজাহান ওমরের সঙ্গে দেখা করেন। বর্তমানে কারাগারে বই পড়েই সময় কাটান শাহজাহান ওমর।
নেতা-কর্মীরা বলছেন, শাহজাহান ওমর প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে নির্বাচনি প্রচার চালিয়েছেন। তার প্রলোভনে স্থানীয় বিএনপির কিছু নেতা-কর্মী দল ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। শাহজাহান ওমরের সঙ্গে তাদের কপালও পুড়েছে। মূলত ক্ষমতার লোভ ও দুর্নীতির মামলা থেকে বাঁচতে শেখ হাসিনার সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন শাহজাহান ওমর।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে ২০২৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ‘তৃণমূল বিএনপি’ নামের (সোনালী আঁশ) একটি দলে যোগ দেন শমসের মবিন চৌধুরী। বিএনপির সাবেক এই ভাইস চেয়ারম্যান অবশ্য তার আগ থেকেই হাসিনা সরকারের পক্ষে এবং বিএনপির বিপক্ষে তৎপর ছিলেন। কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিত তৃণমূল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান প্রয়াত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। শমসের মবিন চৌধুরী বিএনপিতে যোগ দেন ২০০৭ সালে। চারদলীয় জোট সরকার আমলে তিনি পররাষ্ট্রসচিব ছিলেন। বিএনপির সবচেয়ে কঠিন সময় ২০১৫ সালে তিনি দল থেকে পদত্যাগ করেন। ওই বছরের ২৮ অক্টোবর বিএনপি সব পদ থেকে ইস্তফা দেন তিনি। তিন বছর পর যোগ দেন বিকল্পধারা বাংলাদেশে। গত সংসদ নির্বাচনে সিলেট-৬ আসনে শমসের মবিন চৌধুরী তৃণমূল বিএনপির সোনালী আঁশ প্রতীকে অংশ নিয়ে জামানত হারান। ২০২৪ সালের ১৭ অক্টোবর পল্টন ও যাত্রাবাড়ী থানায় হত্যা মামলায় শমসের মবিন চৌধুরীকে আটক করা হয়। গত ২৪ মার্চ তিনি জামিনে কারামুক্ত হন। বর্তমানে রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ অবসরে আছেন বলে জানিয়েছেন শমসের মবিন চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘বাসায় পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি। খুব একটা বাইরে যাওয়া হয় না। রাজনীতি নিয়ে আপাতত কথা বলতে চাচ্ছি না।’
কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম (বীর প্রতীক) ২০০৮ সালে কল্যাণ পার্টি গঠনের পর থেকেই বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জোটের মিত্র হিসেবে তাকে চট্টগ্রাম-৫ আসনটি ছেড়ে দিয়েছিল বিএনপি। বিতর্কিত সেই নির্বাচনে তিনি হেরে যান। বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘ ১৬ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করে ২০২৩ সালের ২২ নভেম্বর চারদলীয় ‘যুক্তফ্রন্ট’ নামে এক জোট গঠন করেন। পরে সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন মুহাম্মদ ইরবাহিম। কক্সবাজার-১ আসনে হাতঘড়ি মার্কায় জয়লাভের নেপথ্যে দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যাপক ভূমিকা ছিল বলে রাজনীতিতে আলোচনা আছে।
ভোটে অংশ নেওয়ায় সেই সময় থেকেই বিএনপি ও ১২-দলীয় জোট নেতাদের সমালোচনার মুখে পড়েন এই রাজনীতিবিদ। আওয়ামী লীগের পতনের পর তিনি সংসদ সদস্য পদ হারান। এর পর থেকেই রাজনীতির আড়ালে চলে গিয়ে নীরবে দিন কাটান ইবরাহিম। বর্তমানে তিনি বাড়িতেই থাকছেন। রাজনৈতিক পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে, নামাজ পড়ে ও কোরআন তিলাওয়াত করেই দিন পার করেন। সম্প্রতি তাকে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে দূতাবাসের একটি অনুষ্ঠানে দেখা যায়।
রাজনীতিতে আলোচনা আছে, শুধু এমপি হওয়ার জন্য ও বড় টাকার লোভে পড়ে তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করেছিলেন।
সৈয়দ ইবরাহিম বলেন, ‘জাতীয়তাবাদী ও ইসলামের জন্য গত ১৭ বছর লড়াই করেছি, এতদূর এসেছি। ৫ আগস্টের পর এখন সবকিছু ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে একটি সুন্দর নির্বাচন হোক। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অটুট থাকুক। সবাইকে নিয়ে দেশ এগিয়ে যাক- এখন এটাই চাই।’
‘বিএনপির পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথা হয়। পার্টির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা রয়েছে। তবে জোটের হয়ে নাকি এককভাবে তা বলার সময় এখনো আসেনি। ৪০-৫০ জনের প্রার্থীদের একটি তালিকা তৈরি করেছি’ যোগ করেন সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা।
দীর্ঘ ১৭ বছর পর রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন বিএনপির একসময়ের প্রভাবশালী নেতা সাবেক এমপি আলী আসগর লবী। চাপে পড়ে তিনি ২০১৯ সালে অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। কয়েক বছর ছিলেন বিদেশে। কিন্তু শেখ হাসিনার পতনের পর দেশে ফেরেন। খুলনা-৫ আসনে তিনি বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন। তবে তার মনোনয়ন পাওয়ায় তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মাঝে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। বিশেষ করে বিগত সাড়ে ১৫ বছর ফ্যাসিবাদের নির্যাতন ও জুলুম সহ্য করে যারা বিএনপির পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ ছিলেন তারা এখন ক্ষুব্ধ। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে সমালোচনার ঝড়। অনেকে বলছেন, বিএনপিতে আগে মধু ছিল না, তাই পদত্যাগ করেছিলেন। মধুর লোভে আবার দলে এসেছেন।
রাজনীতিতে ফেরা ও পদত্যাগের বিষয়ে আলী আজগর লবীর কাছে জানতে চাইলে তিনি শারীরিক অসুস্থতার কথা জানিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
পদত্যাগ করার চার বছর পর আবারও বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন দলটির সাবেক কোষাধ্যক্ষ ও সাবেক স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী মিজানুর রহমান সিনহা। চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি তাকে আহ্বায়ক করে মুন্সীগঞ্জ জেলা বিএনপির কমিটি গঠিত হয়। তিনি মুন্সীগঞ্জ-২ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন। তার ফিরে আসার ঘটনায় কেন্দ্রীয় বিএনপির পাশাপাশি তৃণমূলের অনেক ত্যাগী নেতা-কর্মী ক্ষুব্ধ হয়েছেন। জানা গেছে, আওয়ামী লীগের চাপে পড়ে ২০২০ সালের ২২ জানুয়ারিতে বয়স ও শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে বিএনপির সব পদ থেকে পদত্যাগ করেন একমি গ্রুপের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান সিনহা। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে মুন্সীগঞ্জ-২ আসনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
সিনহার অনুসারী নেতাদের দাবি, শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি রাজনীতি ছাড়েন। চিকিৎসার কারণে দীর্ঘদিন বিদেশ ছিলেন। তার ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে। এখন নিয়মিত কিডনি ডায়ালাইসিস করতে হয়। রাজনীতিতে সশরীরে সক্রিয় না থেকে এলাকায় মানুষের খোঁজখবর রাখছেন নিয়মিত।
এ বিষয়ে মিজানুর রহমান সিনহাকে একাধিকবার মোবাইল ফোনে কল করলেও রিসিভ করেননি। তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে মেসেজ দিলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
আওয়ামী লীগের রাজনীতি দিয়ে পথচলা শুরু করেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলম। ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনের আগে বিএনপিতে যোগদান করেন এবং মেয়র নির্বাচিত হন। তখন তাকে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদ দেওয়া হয়। এরপর ২০১৫ সালে মেয়র নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ওই নির্বাচনে অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগে নির্বাচন বর্জন করেন তিনি। একই সঙ্গে রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই ২০১৬ সালে মনজুর আলম আবারও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগ দেন। ২০২৪ সালের ৫ জানুয়ারি মনজুর আলম স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনি পারিবারিক ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন।
চট্টগ্রাম বিএনপির নেতা-কর্মীরা বলছেন, মনজুর আলমের রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা ছিল নাটক। তার উদ্দেশ্য ছিল আবার মেয়র হওয়া। অনেকে বলছেন, মনজুর আলম সামাজিক-ধর্মীয় ও ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে সময় পার করছেন।
সাবেক মেয়র মনজুর আলম বলেন, ‘বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে আছি। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে পুরোনো রাজনৈতিক বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়।’ তিনি বলেন, ‘আমি রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছি। শরীর আগের মতো নেই।’
বিএনপি থেকে বেরিয়ে কিংস পার্টি বলে পরিচিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) নামে নতুন দল গঠন করে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন সাবেক দুই এমপি শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর ও আব্দুর রহমান। আবু জাফর জাতীয় পার্টি থেকে বিএনপিতে যোগদান করেন ২০০৩ সালে এবং আব্দুর রহমান ১৯৯৬ সালে। ২০২৩ সালের ২০ নভেম্বর বিএনপি ছেড়ে দুজনই বিএনএমে যোগ দেন। তবে সংসদ নির্বাচনে প্রত্যেকেই জামানত হারিয়েছেন। বয়স ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হচ্ছেন না আবু জাফর। বাংলাদেশ ভ্রমণ
বিএনএম চেয়ারম্যান শাহ আবু জাফর বলেন, ‘বিএনএম এখন আর সচল নেই। বর্তমানে বাসায় থাকি। নির্বাচনের পর ভুল স্বীকার করেছিলাম। কিন্তু বিএনপির কেউ সাড়া দেয়নি। ওপরের কারও সঙ্গে যোগাযোগ নেই। তবে নিচের সারির অনেকই ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করেন।’
২০২১ সালের ২৯ জুন স্বাস্থ্যগত কারণে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেন দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক কর্নেল (অব.) মো. শাহজাহান মিয়া। তার গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায়। পদত্যাগের পর এলাকায় তেমন একটা যান না বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
বিএনপির সাবেক সহ-প্রচার সম্পাদক মহিউদ্দিন খান মোহন দল থেকে পদত্যাগ করেন ২০১৬ সালের ১২ আগস্ট। তিনি ২০০১-০৬ পর্যন্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সচিব ছিলেন। বিএনপির সঙ্গে প্রায় ৩৮ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এরপর তাকে রাজনীতিতে তেমন একটা দেখা যায়নি। নিজ জেলা মুন্সীগঞ্জেও তার তেমন কোনো যাতায়াত নেই। তবে শেখ হাসিনার পতনের পর তাকে বিভিন্ন টিভি টকশোতে দেখা গেছে। এ ছাড়া লেখালেখি করে সময় কাটাচ্ছেন।
মহিউদ্দিন খান মোহন বলেন, ‘যেহেতু বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘ সময় ছিলাম, সেহেতু সবার সঙ্গে যোগাযোগ আছে। তবে বিএনপিতে ফেরার কোনো ইচ্ছা নেই। শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বগুণ দেখেই বিএনপিতে যোগদান করেছিলাম। বর্তমানে নিজেকে রাজনীতিতে অযোগ্য মনে হয়। কারণ টাকা ও নিজস্ব বাহিনী লাগে, এর কোনোটাই আমার নেই।’
স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি ‘ডামি’ নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনে অংশ নিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান (সুখন)। তিনি একজন ব্যবসায়ী। নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় ২০২৩ সালের ২৮ নভেম্বর বিএনপি থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। ২০০৮ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিলেও পরাজিত হন একরামুজ্জামান। ডামি নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর ২০২৪ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। অনেকে তাকে সাত মাসের এমপি বলেও অভিহিত করেন। জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকে তিনি পলাতক রয়েছেন। নাশকতা, বিস্ফোরকসহ একাধিক মামলার আসামিও তিনি।
আওয়ামী লীগের প্রলোভনে পড়ে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা তৈমূর আলম খন্দকার এবং কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান। কিন্তু তাদের কেউই সংসদ সদস্য হতে পারেননি, উল্টো জামানত হারিয়েছেন। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ২০২২ সালে তৈমূর আলমকে ও ২০২০ সালে আখতারুজ্জামানকে বহিষ্কার করে বিএনপি।
বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বগুড়া-৪ আসনে দলটির নির্বাহী কমিটির সদস্য জিয়াউল হক মোল্লা ২০২৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি তিনবারের সংসদ সদস্য ছিলেন। ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলে বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব প্রয়াত আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে দলে সংস্কারের দাবিতে সোচ্চার হন জিয়াউল হক মোল্লা। এরপর বিএনপিতে তিনি ‘সংস্কারপন্থি’ হিসেবে পরিচিতি পান। পরবর্তী সময়ে তাকে দলের বিভিন্ন পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ২০০৮ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে তাকে মনোনয়ন না দেওয়ার পাশাপাশি বহিষ্কার করে বিএনপি।
জিয়াউল হক মোল্লা বলেন, ‘প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথাবার্তা হয়। যেহেতু এমপি ছিলাম, সেহেতু এলাকার মানুষের কাছে চাহিদা আছে। তবে এবার আমিও আগ্রহ দেখাইনি। দলও আমাকে ডাকেনি।’ তিনি জানান, বহিষ্কৃত হওয়ার কোনো চিঠি তিনি পাননি।
নানা চাপ ও প্রলোভন সত্ত্বেও বিগত সময়ে যারা দল ছেড়ে যাননি, শেখ হাসিনা-নিয়ন্ত্রিত ডামি নির্বাচনে যারা অংশ নেননি, মনোনয়নের ক্ষেত্রে তাদের মূল্যায়ন করা হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেন খুলনার নজরুল ইসলাম মঞ্জু, মিজানুর রহমান সিনহা, আলী আসগর লবীসহ অনেকে। ২০২৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নিলে হয়তো সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহিম, শাহজাহান ওমর, শমসের মবিন চৌধুরী, তৈমূর আলম খন্দকার, জিয়াউল হক মোল্লা, মেজর (অব.) আখতারুজ্জামানকে মনোনয়নের জন্য বিবেচনা হয়তো করত বিএনপি।সৌজন্যে : খবরের কাগজ
