BD SYLHET NEWS
সিলেটবৃহস্পতিবার, ৬ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, সন্ধ্যা ৬:৪৯
আজকের সর্বশেষ সবখবর

দ্বীনদার জীবনসঙ্গী লাভের উপায় ও করণীয়


নভেম্বর ৫, ২০২৫ ২:১১ অপরাহ্ণ
Link Copied!

সৃষ্টির ধারাকে অব্যাহত রাখার এবং পৃথিবীকে আবাদ করার সুশৃঙ্খল ও পবিত্রতম ইলাহী বিধান হল বিবাহ। এই অনুপম বন্ধন মানুষের আত্মায় এনে দেয় অনাবিল প্রশান্তি, হৃদয়ে দান করে স্থিতি এবং চরিত্রকে উন্নীত করে নিষ্কলুষ পবিত্রতায়, যার মাধ্যমে জীবনে মেলে পরম সুখের ঠিকানা। এর আশ্রয়েই গড়ে ওঠে এমন এক মধুময় দাম্পত্য, যা পারস্পরিক শ্রদ্ধা, গভীর অনুরাগ, স্নেহ-মমতা, ত্যাগ এবং উৎসর্গীকৃত মনোভাবের উপর টিকে থাকে। একজন স্বামী বা স্ত্রী কেবল জীবনসঙ্গী নন, বরং আত্মার বন্ধু, ইবাদতের সঙ্গী এবং জান্নাতের পথে সহযাত্রী। কিন্তু এই অনাবিল প্রশান্তি ও সুখের ঠিকানা বহুলাংশে নির্ভর করে জীবনসফরের সঙ্গী নির্বাচনের মতো একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের উপর। কারণ একটি ভুল নির্বাচন সুন্দর জীবনকে করে তুলতে পারে বিশৃঙ্খল ও কণ্টকাকীর্ণ; প্রশান্তির নীড়কে পরিণত করতে পারে ফিৎনা-ফাসাদের অগ্নিগর্ভে এবং জীবনকে ঠেলে দিতে পারে কষ্ট ও অশান্তির অতল গহবরে। তাই জীবনসঙ্গী নির্বাচন কেবল একটি সামাজিক রীতি নয়, এটি দুনিয়া ও আখেরাতের সৌভাগ্য নির্ধারণকারী এক প্রাজ্ঞ ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত, যা নিতে হয় আল্লাহর উপর ভরসা, পূর্ণ সতর্কতা ও আবেগমুক্ত হৃদয়ে।

১. আত্মিক প্রস্ত্ততি :

জীবনসঙ্গী লাভের এ সফরটি হতাশা বা উদ্বেগের নয়, বরং এটি এক গভীর ঈমান, আন্তরিক দোয়া এবং পবিত্র প্রচেষ্টার এক গুরুত্বপূর্ণ সফর। তবে এ সফরের দিশা খুঁজে পেতে আসুন সফরটা শুরু করি নিজের ভিতর থেকে।
(ক) নিজেকে তেমন মানুষ হিসাবে গড়ে তুলুন, যেমন সাথী আপনি খুঁজছেন :

একবার নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনার জীবনসঙ্গীর মধ্যে যে গুণগুলো খুঁজছেন, সেই গুণগুলো আপনার মধ্যে আছে কি? আপনি যদি একজন তাহাজ্জুদগুযার স্ত্রী বা স্বামী চান, আপনি নিজে তাহাজ্জুদ ছালাত আদায় করেন কি? আপনি যদি একজন সৎ ও চরিত্রবান মানুষ চান, আপনি নিজে সেই সততার আয়না হতে পেরেছেন কি?

পবিত্র কোরআনের ইলাহী বাণীটি স্মরণ করুন, ‘সচ্চরিত্রা নারী সচ্চরিত্র পুরুষের জন্য এবং সচ্চরিত্র পুরুষ সচ্চরিত্রা নারীর জন্য’ (সুরা নূর ২৪/২৬)। এটি আল্লাহর ওয়াদা। আপনি নিজেকে যত পবিত্র ও সুন্দর করে গড়ে তুলবেন, আল্লাহ আপনার জন্য ঠিক ততটাই পবিত্র ও সুন্দর কাউকে নির্ধারণ করে রাখবেন ইনশাআল্লাহ।

তাই অন্যের অপেক্ষায় না থেকে আজ থেকেই নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার কাজে নেমে পড়ুন! আপনার প্রতিটি সৎকর্ম আপনার সেই জান্নাতী সাথীর কাছে পৌঁছানোর পথ তৈরী করে দিবে ইনশাআল্লাহ।
(খ) আল্লাহর সাথে একান্তে কথা বলুন

ভাবুন তো একবার, রাতের আকাশ যখন তারাদের আলোয় ঝলমল করছে, চারপাশ যখন গভীর ঘুমে অচেতন, তখন আপনি জেগে আছেন। আপনি দাঁড়িয়েছেন আপনার মহান রবের সামনে, সিজদায় লুটিয়ে পড়ছেন আর আপনার হৃদয়ের সব আকুতি, সব স্বপ্ন, সব না বলা কথাগুলো চোখের পানিতে মিশিয়ে তাঁর কাছে পেশ করছেন।

ঠিক এভাবেই রাতের তৃতীয় প্রহরে প্রতিপালকের দরবারে পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে মনের আকুতি তুলে ধরুন। এটাই তো সেই সময় যখন রাববুল আলামীন দুনিয়ার আসমানে নেমে এসে বলেন, কে আছ আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দিব! কে আছ আমার নিকটে কিছু চাইবে, আমি তাকে প্রদান করব! কে আছ আমার নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করে দিব! (সহহি বুখারি, হাদিস : ১১৪৫; সহিহ মুসলিম, হাদিস :৭৫৮;

অথবা দিনের যেকোনো সময় দুই রাকাত সালাতুল হাজাত বা প্রয়োজন পূরণের সালাত আদায় করুন।

তারপর আল্লাহর কাছে বলুন, হে আমার রব! আমার জীবনে এমন একজন সঙ্গী মিলিয়ে দিন, যাকে দেখলে আমার চোখ জুড়িয়ে যায়, যার কথায় আমার আত্মা প্রশান্তি পায়। এমন একজন মানুষ দিন, যিনি আপনার প্রিয় বান্দা হবেন। যিনি আমাকে আপনার আরও কাছে নিয়ে যাবেন। যার হাত ধরে আমি আপনার আরও প্রিয় বান্দা হ’তে পারব। যিনি আমাকে যাবতীয় পাপ থেকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করবেন।
আমাদেরকে চাইতে হবে এমন একজন তাক্বওয়াশীল সাথী, যিনি কেবল জীবনের সুখ-দুঃখের অংশীদারই হন না, হয়ে ওঠেন জান্নাতের পথে একজন পথপ্রদর্শক, ভুলের সময় একজন স্নেহময় অভিভাবক এবং ইবাদতে অলসতা এলে একজন অনুপ্রেরণাদায়ী বন্ধু। তাঁর উন্নত দ্বীনদারী ও উত্তম আখলাক প্রতিনিয়ত নিজের ঈমানকে শাণিত করতে এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভে সহায়তা করবে।

আর আল্লাহর নিকটে প্রার্থনার সময় নিম্নের দো‘আগুলো আকুতিভরে পাঠ করুন-

(১) رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ-

উচ্চারণ : (রববানা আ-তিনা ফিদ্দুন্ইয়া হাসানাতাঁও ওয়া ফিল আ-খিরাতে হাসানাতাঁও ওয়া ক্বিনা আযা-বান্না-র)।

অর্থ: ‘হে আল্লাহ! হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি আমাদেরকে দুনিয়াতে মঙ্গল দাও ও আখেরাতে মঙ্গল দাও এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচাও’। (বুখারি, হাদিস : ৪৫২২, ৬৩৮৯)

(২) يَا حَىُّ يَا قَيُّوْمُ بِرَحْمَتِكَ أَسْتَغِيْثُ

উচ্চারণ : ‘ইয়া হাইয়ু ইয়া ক্বাইয়ূমু বিরহমাতিকা আস্তাগীছ’

অর্থ: (হে চিরঞ্জীব! হে বিশ্বচরাচরের ধারক! আমি আপনার রহমতের আশ্রয় প্রার্থনা করছি)। (তিরমিযী, মিশকাত হা/২৪৫৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৭৭৭)

(৩) رَبِّ إِنِّي لِمَا أَنْزَلْتَ إِلَيَّ مِنْ خَيْرٍ فَقِيرٌ

উচ্চারণ : ‘রবিব ইন্নী লিমা আনযালতা ইলাইয়া মিন খয়রিন ফাক্বীর’। হে আমার প্রতিপালক! আমি তোমার পক্ষ হ’তে আমার প্রতি কল্যাণ নাযিলের মুখাপেক্ষী (ক্বাছাছ ২৮/২৪)।

(৪) حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ

উচ্চারণ : ‘হাসবুনাল্ল-হু ওয়া নি‘মাল ওয়াক্বীল’।

অর্থ: ‘আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক’! (তিরমিজি, হাদিস : ৩২৪৩)

উল্লেখ্য, উক্ত দোয়াগুলো বিবাহের জন্য নির্দিষ্ট নয়। বরং যেকোনো বিপদ-আপদ, দুশ্চিন্তা-সংকট বা যেকোনো প্রয়োজনে আল্লাহ সাহায্য লাভের আশায় এবং যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা প্রকাশের জন্য পাঠ করা হয়।

(গ) বেশী বেশী ক্ষমা প্রার্থনা করুন

যারা একজন দ্বীনদার, চরিত্রবান ও প্রশান্তিদায়ক জীবনসঙ্গী খুঁজছেন, তাদের জন্য জাগতিক চেষ্টার পাশাপাশি আল্লাহর দরবারে নিয়মিত ইস্তিগফার করা অত্যন্ত যরূরী। এটি কেবল পাপ মোচন করে না, বরং আল্লাহর রহমতের দরজা খুলে দেয় এবং উত্তম জীবনোপকরণের ব্যবস্থা করে দেয়।

আল্লাহ বলেন, وَأَنِ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُوا إِلَيْهِ يُمَتِّعْكُمْ مَتَاعًا حَسَنًا إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى وَيُؤْتِ كُلَّ ذِي فَضْلٍ فَضْلَهُ-

‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর ও তাঁর দিকে ফিরে যাও। তিনি তোমাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ দান করবেন নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত এবং প্রত্যেক সৎকর্মশীলকে তার প্রতিদান দিবেন’। (সুরা হূদ আয়াত : ৩)

অতএব আপনার একাকীত্বের দুশ্চিন্তা আর সঙ্গী না পাওয়ার হতাশাকে আজই বদলে দিন একনিষ্ঠ ইস্তিগফারে। হৃদয় খুলে পাঠ করতে থাকুন ক্ষমা প্রার্থনার অন্তর শীতলকারী সব দো‘আগুলো। বিশ্বাস রাখুন, যেমনিভাবে ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে আপনার আত্মা পরিশুদ্ধ হচ্ছে, ঠিক তেমনি আল্লাহ আপনার জন্য একজন পরিশুদ্ধ ও উত্তম জীবনসঙ্গী মিলিয়ে দেয়ার পথকেও মসৃণ করে দিচ্ছেন। কেবল আন্তরিকতার সাথে বিনীতচিত্তে ক্ষমা চেয়ে যান, বাকিটা তাঁর হাতে ছেড়ে দিন, তিনিই আপনার জন্য শ্রেষ্ঠ পরিকল্পনাকারী।

(ঘ) ফেরেশতার দোয়াতেও খুলে যেতে পারে আপনার ভাগ্য :

উত্তম জীবনসঙ্গীর জন্য হৃদয়ের গভীরে কতই না আকুতি জমা হয়। জায়নামাযে বসে কতশত অশ্রু ফেলি। কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছেন কি, যে আপনার নিজের বিবাহের পথের তালা খোলার চাবিকাঠিটি হয়তো আপনারই কোনো বন্ধুর বিবাহের জন্য করা আন্তরিক দোয়ার মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে?

যখন আপনি নিজের প্রয়োজন ভুলে গিয়ে অন্য কারো শূন্যতা পূরণের জন্য হাত তোলেন, তখন আসমানে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য তৈরি হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের শিখিয়েছেন সেই ভালোবাসার প্রতিদান, যখন কোনো ব্যক্তি তার ভাইয়ের জন্য তার অনুপস্থিতিতে দোয়া করে, তখন একজন ফেরেশতা নিযুক্ত হন। আপনি যখনই বলেন, ‘হে আল্লাহ! আমার বোনটির জন্য একজন উত্তম জীবনসাথী মিলিয়ে দিন’, তখন সেই ফেরেশতা উত্তরে বলেন, آمِينَ، وَلَكَ بِمِثْلٍ ‘আমীন! তোমার জন্যও অনুরূপ হৌক’। (সহিহ মুসলিম, হাদিস:২৭৩২)

একবার ভেবে দেখুন তো! আপনার নিজের দোয়ার চেয়েও কত বেশী শক্তিশালী সেই ফেরেশতার দোয়া, যিনি নিষ্পাপ এবং যিনি সরাসরি আল্লাহর নির্দেশে আপনার জন্য প্রার্থনা করছেন। আপনি অন্যের জন্য যে ঘর সাজানোর স্বপ্ন দেখছেন, আল্লাহ পর্দার আড়ালে আপনার ঘর সাজানোর প্রস্ত্ততি শুরু করে দেন।

অনুরূপ যখন আপনি কারো বিবাহের জন্য দৌড়ঝাঁপ করেন, ভালো পাত্র বা পাত্রীর খোঁজ দেন, তখন আপনি আসলে আল্লাহর সৃষ্টির সাহায্যে এগিয়ে আসেন। আর ওয়াদা তো এটাই, ‘বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সাহায্যে রত থাকে, আল্লাহর ততক্ষণ তার সাহায্যে রত থাকেন’। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৬৯৯)

২. বাস্তব পদক্ষেপ :

(ক) সম্মানের সাথে পবিত্র পন্থায় খুঁজুন

আপনার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটিকে খোঁজার পথটিও হতে হবে সবচেয়ে সম্মানিত ও পবিত্র। তাই পরিবারের ছায়ায় পাত্রী খুঁজুন। আপনার পিতা-মাতা, ভাই-বোন এঁরাই আপনার সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী। তাদের অন্তরখোলা দো‘আ আর অভিজ্ঞতার ছায়ায় খোঁজ-খবর শুরু করুন। তাদের মাধ্যমে আসা সম্বন্ধে যে বরকত থাকে, তা আর কিছুতে নেই।

আপনি আপনার অভিভাবকদের কাছে আপনার পসন্দের ধরন, আপনার দ্বীনী ও চারিত্রিক মানদন্ড এবং ভবিষ্যৎ জীবনের পরিকল্পনা সম্পর্কে বিনয়ের সাথে খুলে বলতে পারেন।

পরিবারের বাইরেও বিশ্বস্ত মধ্যস্থতাকারীর সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। যেমন ইসলামী সংগঠনের সাথে জড়িত ভাই-বোনদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে, পরিচিত কোন পরহেযগার শিক্ষক বা উস্তাদের মাধ্যমে, অথবা পরিচিত দ্বীনদার সাথী, সহপাঠীর মাধ্যমে হ’তে পারে। এছাড়া শরী‘আহভিত্তিক ম্যারেজ মিডিয়ার সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। তবে সেক্ষেত্রেও পুরো প্রক্রিয়াটি যেন পরিবারের তত্ত্বাবধানেই সম্পন্ন হয়, সেব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

(খ) হারাম সম্পর্ক থেকে দূরে থাকুন

বৈবাহিক সম্পর্ক কোনো জাগতিক আকর্ষণে টিকে থাকে না; বরং এটি টিকে থাকে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো ভালোবাসা ও রহমতের এক অদৃশ্য বাঁধনে। রক্তের সম্পর্কে বছরের পর বছর একসাথে থেকেও সম্পর্কের যে গভীরতা তৈরি হয় না, তার চেয়েও বহুগুণ বেশী আস্থা, নির্ভরতা আর ভালোবাসা হঠাৎ জন্মে যায় দু’টি মানুষের মধ্যে, যারা একদিন পরস্পরের জন্য ছিল সম্পূর্ণ অচেনা। এই অলৌকিক অনুভূতি, এই গভীর সংযোগ কেবলই মহান সৃষ্টিকর্তার এক বিশেষ দান।

আল্লাহ নিজেই বলছেন, তাঁর নিদর্শনাবলীর অন্যতম হ’ল, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হ’তেই সৃষ্টি করেছেন তোমাদের স্ত্রীদের, যাতে তোমরা তাদের নিকট স্বস্তি লাভ করতে পার। আর তিনি তোমাদের উভয়ের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন ভালোবাসা ও রহমত। নিশ্চয়ই এর মধ্যে নিদর্শন সমূহ রয়েছে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য (সুরা রূম আয়াত : ২১)

এই জান্নাতী রহমত ও ভালোবাসা আল্লাহ কেবল তাঁর নির্ধারিত বৈধ ও পবিত্র সম্পর্কের জন্যই রেখেছেন। যারা হারাম পথে এই প্রশান্তি খোঁজে, তারা সাময়িক আকর্ষণ পেলেও কখনোই হৃদয়ের সেই স্থায়ী ও গভীর ভালোবাসা লাভ করতে পারে না। যে সম্পর্কের সূচনা হয় আল্লাহর অবাধ্যতা দিয়ে, সেই সম্পর্কে কখনো রহমত ও বরকত থাকতে পারে না। কাঁচের ঘরের মতো সেই সম্পর্ক সামান্য আঘাতেই চুরমার হয়ে যায়। যে মানুষটি বিবাহের আগেই আপনাকে আল্লাহর অবাধ্য হ’তে শেখায়, গোনাহের পথে পা বাড়াতে সহযোগিতা করে, সে বিবাহের পরে কিভাবে আপনাকে জান্নাতের পথে এগিয়ে নিবে? অতএব ঘুণাক্ষরেও হারামের পথে হাঁটবেন না।

(গ) আত্মার সৌন্দর্যকে গুরুত্ব দিন

জীবনসঙ্গী নির্বাচনের সময় আমরা প্রায়ই বাইরের চাকচিক্য দেখে বিভ্রান্ত হই। কিন্তু আসল সৌন্দর্য তো লুকিয়ে থাকে দ্বীনদারী আর চরিত্রে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সেই অমর বাণী হৃদয়ে গেঁথে নিন,

(১) فَاظْفَرْ بِذَاتِ الدِّينِ تَرِبَتْ يَدَاكَ ‘তোমরা দ্বীনদার নারীকে প্রাধান্য দাও, অন্যথা তোমাদের উভয় হস্ত ধূলায় ধূসরিত হৌক (অর্থাৎ তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে)’।

(২) إِذَا أَتَاكُمْ مَنْ تَرْضَوْنَ دِينَهُ وَخُلُقَهُ فَزَوِّجُوهُ ‘যখন তোমাদের কাছে এমন কারো প্রস্তাব আসে, যার দ্বীনদারী এবং উত্তম আচরণে তোমরা সন্তুষ্ট হও, তার সাথে বিবাহ দাও’। যদি তা না কর তবে পৃথিবীতে ফাসাদ বিস্তৃত হবে। সাহাবীগণ বললেন, হে রাসূল! যদি তার মাঝে (কুফূ-এর দিক থেকে) কিছু ক্রটি থাকে? জবাবে তিনি তিনবার (তাকিদ দিয়ে) বললেন, যখন তোমাদের কাছে এমন কারো প্রস্তাব আসে যার দ্বীন ও চরিত্র তোমাদের পসন্দ হয়, তার সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে। (তিরমিজি, হাদিস : ১০৮৫)

রাসুল (সা.)-এর উক্ত নির্দেশনা থেকে বুঝা যায় যে, সুখী ও প্রশান্তিময় জীবনের ভিত্তি হল পারস্পরিক দ্বীনদারী ও উত্তম আখলাক। তাই পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে ক্ষণস্থায়ী মোহকে ত্যাগ করে দ্বীনদারীকেই সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিন। পূর্ণ বিশ্বাস রাখুন, যখন আপনি আল্লাহর সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দেবেন, তখন তিনি আপনার অন্যান্য দুনিয়াবী কামনা-বাসনাও পূরণ করে দেবেন এবং দাম্পত্য জীবনে অশেষ বরকত দান করবেন ইনশাআল্লাহ।

চেষ্টা করুন সেই মানুষটির আত্মার গভীরে তাকাতে। দেখুন, তার চোখে আল্লাহর ভয় আছে কি-না। তার আচরণে নম্রতা ও দয়া আছে কি-না। কারণ সৌন্দর্য একদিন ফুরিয়ে যাবে, সম্পদও শেষ হয়ে যেতে পারে, কিন্তু একজন নেককার জীবনসঙ্গীর উত্তম চরিত্র আপনার জীবনকে আজীবন আলোকিত করে রাখবে।

(ঘ) ইস্তেখারাহ করুন :

যখন কোন প্রস্তাব আসবে, তখন নিজের সীমিত জ্ঞান দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যাবেন না। আপনার জীবনের সিদ্ধান্তের ভার তুলে দিন তাঁর হাতে, যিনি আসমান ও যমীনের সবকিছুর খবর রাখেন। দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করে একনিষ্ঠভাবে পূর্ণ ভরসা রেখে আল্লাহর কাছে বলুন, হে আল্লাহ! যদি এই সম্পর্ক আমার দ্বীন, দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য কল্যাণকর হয়, তবে আমার হৃদয়কে এর জন্য প্রশস্ত করে দাও এবং কাজটা আমার জন্য সহজ করে দাও। আর যদি এতে অকল্যাণ থাকে, তবে একে আমার থেকে দূরে সরিয়ে নাও এবং আমার মনকে তোমার সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট করে দাও।

জাবের (রা) বলেন, রাসলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে সকল কাজে ‘ইস্তেখারাহ’ শিক্ষা দিতেন, যেভাবে তিনি আমাদেরকে কুরআনের সূরা শিক্ষা দিতেন। তিনি বলেছেন, তোমাদের কেউ যখন কোন কাজের সংকল্প করবে, তখন ফরয ব্যতীত দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করবে। অতঃপর বলবে,

اَللَّهُمَّ إِنِّيْ أَسْتَخِيْرُكَ بِعِلْمِكَ، وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ، وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ الْعَظِيْمِ، فَإِنَّكَ تَقْدِرُ وَلاَ أَقْدِرُ وَتَعْلَمُ وَلاَ أَعْلَمُ، وَأَنْتَ عَلاَّمُ الْغُيُوْبِ، اَللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الْأَمْرَ خَيْرٌ لِّيْ فِيْ دِيْنِيْ وَمَعَاشِيْ وَعَاقِبَةِ أَمْرِيْ فَاقْدِرْهُ لِيْ وَيَسِّرْهُ لِيْ ثُمَّ بَارِكْ لِيْ فِيْهِ، وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الْأَمْرَ شَرٌّ لِّيْ فِيْ دِيْنِيْ وَمَعَاشِيْ وَعَاقِبَةِ أَمْرِيْ فَاصْرِفْهُ عَنِّيْ وَاصْرِفْنِيْ عَنْهُ وَاقْدِرْ لِيَ الْخَيْرَ حَيْثُ كَانَ ثُمَّ أَرْضِنِيْ بِهِ، قَالَ: (وَيُسَمِّي حَاجَتَهُ)-

উচ্চারণ: ‘আল্ল-হুম্মা ইন্নী আস্তাখীরুকা বি‘ইলমিকা ওয়া আস্তাক্বদিরুকা বি ক্বুদরাতিকা, ওয়া আসআলুকা মিন ফাযলিকাল ‘আযীম। ফাইন্নাকা তাক্বদিরু ওয়া লা আক্বদিরু, ওয়া তা‘লামু ওয়া লা আ‘লামু, ওয়া আনতা ‘আল্লা-মুল গুয়ূব। আল্লা-হুম্মা ইন কুনতা তা‘লামু আন্না হা-যাল আমরা খায়রুল লী ফী দ্বীনী ওয়া মা‘আ-শী ওয়া ‘আ-ক্বিবাতি আমরী, ফাক্বদিরহু লী ওয়া ইয়াসসিরহু লী; ছুম্মা বা-রিক লী ফীহি। ওয়া ইন কুনতা তা‘লামু আন্না হা-যাল আমরা শার্রুল লী ফী দ্বীনী ওয়া মা‘আ-শী ওয়া ‘আ-ক্বিবাতি আমরী, ফাছরিফহু ‘আন্নী ওয়াছরিফনী ‘আনহু, ওয়াক্বদির লিয়াল খায়রা হায়ছু কা-না, ছুম্মা আরযিনী বিহী।

অনুবাদ : হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট তোমার জ্ঞানের সাহায্যে কল্যাণের বিষয়টি প্রার্থনা করছি এবং তোমার শক্তির মাধ্যমে (সেটা অর্জন করার) শক্তি প্রার্থনা করছি। আমি তোমার মহান অনুগ্রহ ভিক্ষা চাইছি। কেননা তুমিই ক্ষমতা রাখ। আমি ক্ষমতা রাখি না। তুমিই জানো, আমি জানি না। তুমিই যে অদৃশ্য বিষয় সমূহের মহাজ্ঞানী।

হে আল্লাহ! যদি তুমি জানো যে, এ কাজটি আমার জন্য উত্তম হবে আমার দ্বীনের জন্য, আমার জীবিকার জন্য ও আমার পরিণাম ফলের জন্য, তাহ’লে ওটা আমার জন্য নির্ধারিত করে দাও এবং সহজ করে দাও। অতঃপর ওতে আমার জন্য বরকত দান কর।

আর যদি তুমি জানো যে, এ কাজটি আমার জন্য মন্দ হবে আমার দ্বীনের জন্য, আমার জীবিকার জন্য ও আমার পরিণাম ফলের জন্য, তাহ’লে এটা আমার থেকে ফিরিয়ে নাও এবং আমাকেও ওটা থেকে ফিরিয়ে রাখ। অতঃপর আমার জন্য মঙ্গল নির্ধারণ কর, যেখানে তা আছে এবং আমাকে তা দ্বারা সন্তুষ্ট কর’।

এখানে হা-যাল আম্রা (এই কাজ) বলার সময় কাজ বা কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা যায় বলে রাবী বর্ণনা করেন। যা উপরোক্ত হাদীছের শেষে বর্ণিত হয়েছে। (আবু দাঊদ, হাদিস : ১৫৩৮)

উল্লেখ্য যে, ইস্তেখারাহ করার অর্থ এই নয় যে, আপনি স্বপ্নে স্পষ্ট নির্দেশনা পেয়ে যাবেন। বরং ইস্তিখারার পর আপনার মন হয়তো কোন একটি সিদ্ধান্তের প্রতি বেশী ঝুঁকে পড়বে। অথবা যে প্রস্তাবটি আপনার জন্য কল্যাণকর, সেটির বাধা-বিপত্তি দূর হয়ে যাবে এবং তা সহজ হয়ে যাবে। আর যে প্রস্তাবটি অকল্যাণকর, সেটির পথে নতুন কোন বাধা তৈরি হবে বা আপনার মন তা থেকে আপনা থেকেই সরে আসবে। সুতরাং বিবাহের প্রস্তাবে বিশেষত দোদুল্যমান অবস্থায় থাকলে নিজের বিবেক-বুদ্ধি ও পরামর্শের পাশাপাশি অবশ্যই ইস্তেখারাহ করা উচিত, যাতে আল্লাহর সাহায্যে সঠিক ও কল্যাণকর সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করা যায়।

৩. আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রাখুন

সর্বশেষ পরামর্শ- বিশ্বাস রাখুন! নিশ্চিত থাকুন! ধৈর্য ধরুন! ছবর বা ধৈর্যের চেয়ে সুন্দর কোন গুণ নেই। একজন কৃষক যেমন বীজ বপন করে, পানি দেয়, সার দেয় এবং তারপর ফসলের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে, ঠিক তেমনি আপনিও দো‘আ ও চেষ্টার বীজ বপন করেছেন। এবার ফলাফলের জন্য ছবরের সাথে অপেক্ষা করুন। আল্লাহ বলেন, وَاسْتَعِيْنُوْا بِالصَّبْرِ وَالصَّلاَةِ وَإِنَّهَا لَكَبِيْرَةٌ إِلاَّ عَلَى الْخَاشِعِيْنَ ‘তোমরা ধৈর্য ও ছালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও’ (সুরা বাক্বারা: আয়াত: ৪৫)।

বিশ্বাস রাখুন, আল্লাহ আপনার ডাক শুনছেন। তিনি আপনার একাকীত্ব দেখছেন। তিনি আপনার জন্য এমন কিছু পরিকল্পনা করে রেখেছেন, যা আপনার কল্পনার চেয়েও সুন্দর। তাঁর নির্ধারিত সময়ে, আপনার জন্য শ্রেষ্ঠ মানুষটি আপনার জীবনে ঠিকই আসবে। সেই দিন আপনি বুঝবেন, আপনার প্রতিটি দোয়া, প্রতিটি রাতের চোখের পানি আর প্রতিটি দিনের ধৈর্য বৃথা যায়নি।

এই ভরসা আপনার মনের গভীর প্রশান্তি এনে দিবে এবং দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিবে। আপনার মনে বিশ্বাস জন্মাবে যে আল্লাহ আমার জন্য যা নির্ধারণ করেছেন, সেটাই সর্বোত্তম হবে। এই বিশ্বাস আপনাকে হতাশা ও অধৈর্য হওয়া থেকে রক্ষা করবে এবং তাড়াহুড়ো বা সামাজিক চাপের মুখে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকেও বাঁচাবে।

নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টার পর যে ফলাফলই আসুক না কেন, তা আল্লাহর সিদ্ধান্ত হিসাবে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেওয়ার মধ্যেই তাওয়াক্কুলের পূর্ণতা নিহিত। বিশ্বাস রাখতে হবে যে, এর মধ্যেই চূড়ান্ত কল্যাণ রয়েছে, যা হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের চোখে পড়ছে না।

আল্লাহ আপনার এই পবিত্র সফরকে সহজ করুন এবং আপনাকে এমন একজন জীবনসঙ্গী দান করুন, যিনি হবেন আপনার দুনিয়ার শান্তি আর জান্নাতের পথের একান্ত সাথী। আমীন!

কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।