মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৪০ অপরাহ্ন
বিডিসিলেট ডেস্ক : বিগত ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বেসরকারি প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে কমপক্ষে ৩০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। দীর্ঘ সাড়ে চার বছরের এ সময়ে উচ্চশিক্ষালয়টির এফডিআর ভেঙ্গে ও আর্থিক অনিয়মের মাধ্যমে এ অর্থ লোপাট করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৫ কোটি টাকাই সরানো হয়েছে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে থাকা এফডিআর ভেঙ্গে। বেসরকারি এ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রিজার্ভ ফান্ড এবং নিয়মিত ফান্ড থেকে এসব অর্থ সরিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব প্রাপ্তরা।
সম্প্রতি প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির আর্থিক বিবরণী, আভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদন এবং সংশ্লিষ্ট হিসাবাদি বিশ্লেষণে এসব অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। আর এসব অনিয়মে জড়িত ছিলেন—প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্ট্রিজের (বিওটি) সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান রায়হান আজাদ টিটু। এর আগে নানা অনিয়মরে অভিযোগে তাঁকে সেখান থেকে অপসারণও করা হয়েছিল।
যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, তা সত্য নয়। যারা এসব অভিযোগ করছেন—তারা এসব অভিযোগ প্রমাণ করুক—ড. ইফ্ফাত জাহান, ট্রেজারার, প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি।
এছাড়াও এ অনিয়মে জড়িত ছিলেন শেখ হাসিনার ছোটবোন শেখ রেহানার বান্ধবী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ট্রেজারার ড. ইফ্ফাত জাহান, ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য ড. শুভময় দত্ত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব শাখার পরিচালক (সাময়িক বরখাস্তকৃত) শিপার আহমেদ।
আর এসব অনিয়মে অভিযুক্তদের সহায়তা করেছেন প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির ভর্তি ও বিপণন শাখার সাময়িক বরখাস্তকৃত সহকারী পরিচালক তানভীর আহমেদ, ক্রয় বিভাগ থেকে পদত্যাগ করা সহকারী পরিচালক নাহিদ হাসান ও সহকারী পরিচালক জুবায়ের সিদ্দিক তানিন।
এছাড়াও এ অপকর্মে সহায়তা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির একজন খণ্ডকালীন শিক্ষকও; তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ প্রোগামের অপসারিত শিক্ষক সায়েদ ফেরদৌস মুগ্ধ। তিনি টিটুর ঘনিষ্ঠ এবং বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশৃঙ্খলাকারীদের সাথে সম্পর্ক রেখেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির নির্মাণাধীন স্থায়ী ক্যাম্পাস, নিরাপত্তা সংস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অফিসের সাজসজ্জা, পরিষ্কার-পরিছন্নতা, পরামর্শক, ডিজিটাল মার্কেটিং এবং শিক্ষার্থী ভর্তি ফি নগদ গ্রহণকালে এসব আর্থিক অনিয়ম করা হয়েছে।
এছাড়াও অনিয়ম করা হয়েছে—বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অসবাবপত্র ক্রয়, বিজ্ঞাপন প্রচার, গাড়ি ক্রয় ও মেইনটেন্যান্স, জ্বালানি ক্রয় এবং বিভিন্ন গবেষণাগারের সামগ্রী ক্রয়সহ নানা খাতে আর্থিক অনিয়ম হয়েছে। বিগত সাড়ে চার বছরের বিভিন্ন সময়ে বেসরকারি এ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসব অনিয়মে জড়িয়েছেন অভিযুক্তরা।
একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পোর্টস ক্লাবের সদস্যপদ বিক্রি করা হয়েছে উচ্চশিক্ষালয়টির বর্তমান এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের নিকট। প্রাইম এশিয়ার স্পোর্টস ক্লাবের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জুবায়ের সিদ্দিক তানিন এর মাধ্যমে প্রায় ৭ লক্ষ টাকার অনিয়ম করেছেন। এ বিষয়ে হিসাব চাইলেও তার কোনো হিসাব তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দিতে পারেননি।
এর বাইরে অনিয়ম করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ নিয়েও। এখন পর্যন্ত প্রায় কোটি টাকা খরচ হলেও অভিযুক্ত রায়হান আজাদ টিটুর ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ইনফিকম এস এ কনস্ট্রাকশন বাংলাদেশ লিমিটেড নাম একটি ভুঁইফোঁড় কোম্পানির সাথে চুক্তি করা হয়েছে ৮ কোটি ৭২ লক্ষ টাকায়। আর এতে প্রায় প্রায় ৪ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা। বিগত ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে সম্পন্ন এ চুক্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে স্বাক্ষর করেন তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য ও ট্রেজারার ড. ইফ্ফাত জাহান।
এছাড়াও প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দকৃত ক্যান্টিন ভাড়া বাবদ ৫ বছরে প্রায় ৫ কোটি টাকার বেশি ভাড়া বাবদ আটকে রয়েছে অভিযুক্ত রায়হান আজাদ টিটুর নিকট। পাশাপাশি একই ক্যান্টিনের ভাড়া বকেয়া রেখে সেটি ভাগে ভাগে অন্যদের নিকট ভাড়া দিয়ে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে টিটুর বিরুদ্ধে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকের ঋণ খেলাপির অভিযোগে টিটুর বিরুদ্ধে দুদকে তদন্ত চলমান থাকায় তিনি বর্তমানে পলাতক রয়েছেন। এর আগে প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্ট্রিজের (বিওটি) সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন রায়হান আজাদ টিটু।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বর্তমানে বকেয়া রয়েছে সেখানকার শিক্ষকদের বেতন-ভাতাও। আর রায়হান আজাদ টিটু এবং ট্রেজারার ড. ইফ্ফাত জাহানের সময়কাল থেকে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন খাতে বকেয়া, উইথ-হোল্ডিং ট্যাক্স-ভ্যাট, ভাড়া ও অন্যান্য খরচ বাবদ দায় ৩০ কোটিরও বেশি হয়েছে।
আর বিগত ২০২০ সাল থেকে প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটিতে কোনো ধরনের অডিট না হওয়া, ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল না করার ফলে এসব অনিয়ম করার সুযোগ পেয়েছে অভিযুক্তরা। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো আর্থিক বিবরণী প্রস্তুত না হওয়া এবং দেশের উচ্চশিক্ষার তদারক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনে (ইউজিসি) কোনো প্রতিবেদনও জমা দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয়টি।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার নিয়োগে লঙ্ঘন করা হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ এর সংশ্লিষ্ট ধারাও। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় আর্থিক এবং প্রশাসনিক দক্ষতা রয়েছে এমন কাউকে নিয়োগের শর্ত থাকলেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল একটি কলেজে মানবিক বিভাগে শিক্ষকতা থাকা ইফ্ফাত জাহানকে। তার অদক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা না থাকায় ভেঙ্গে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় আর্থিক এবং প্রশাসনিক কাঠামো। এতে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রায় ৩০ কোটি টাকারও বেশি আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা।
আর এসব ঘটনায় অভিযুক্ত এবং বহিষ্কৃত রায়হান আজাদ টিটু, শিপার আহমেদ, নাহিদ হাসান, তানভীর আহমেদ, জুবাইর সিদ্দিক তানিন , সায়েদ ফেরদৌস মুগ্ধসহ সংশ্লিষ্টরা তাদের অনিয়ম এবং দুর্নীতির ঘটনা আড়াল করতে নানা ধরনের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন। এছাড়াও মুগ্ধ-তানিনের নেতৃত্বে শিক্ষকদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে।
প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির নির্মাণাধীন ক্যাম্পাস। তবে এ ক্যাম্পাস নির্মাণের চুক্তির স্বচ্ছতা নিয়ে নানা অনিয়মরে অভিযোগ রয়েছে। ছবি: সৌজন্যে প্রাপ্ত।
অন্যদিকে বর্তমানে প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারীদের জুলাই ও আগস্ট মাসের বেতন অপরিশোধিত থাকায় শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারীদের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করছে।
প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্ট্রিজের (বিওটি) সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান রায়হান আজাদ টিটুকে সহায়তার অভিযোগ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির এমবিএ প্রোগামের অপসারিত শিক্ষক সায়েদ ফেরদৌস মুগ্ধের বিরুদ্ধে। তবে দিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন, তিনি কারও সহায়তা করেননি এবং কোনো ধরনের অনিয়মও করেননি। এছাড়াও নিজেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরি ছেড়ে এসেছেন, তাকে অপসারণ করা হয়নি বলেও দাবি করেছেন তিনি।
এছাড়াও প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটিতে বড় ধরনের এ অনিয়মে জড়িত অন্যদের সাথে একাধিক মাধ্যমে চেষ্টা করেও তাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
সামগ্রিক বিষয় নিয়ে জানতে কথা হয় প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির ট্রেজারার ড. ইফ্ফাত জাহানের সঙ্গে। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, তা সত্য নয়। যারা এসব অভিযোগ করছেন—তারা এসব অভিযোগ প্রমাণ করুক।
সবগুলো অভিযোগের বিষয়ে জানতে একাধিক মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করা প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্ট্রিজের (বিওটি) সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান রায়হান আজাদ টিটুর সাথে। বিভিন্ন সময়ে চেষ্টা করেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে তার ঘনিষ্ঠ জনদের থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকের ঋণ খেলাপির অভিযোগে টিটুর বিরুদ্ধে দুদকে তদন্ত এবং তিনিসহ তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা চলমান থাকায় তিনি বর্তমানে পলাতক রয়েছেন। সুত্র: দি ডেইলি ক্যাম্পাস