শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৩২ অপরাহ্ন
লাইফস্টাইল ডেস্ক : ইসলাম ধর্মের পবিত্রতম মাস রমজান। এই মাসে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আল্লাহকে খুশি করার উদ্দেশে মাসব্যাপী রোজা রাখেন। রমজান মাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো ইফতার। অনেক দেশে এটি ‘ইফতর’ নামেও পরিচিত।
জনসংখ্যা বিষয়ক অনলাইন ডেটাবেজ ‘ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ’ (ডব্লিউপিআর) থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ২০০ কোটি মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী।
এই বিশাল জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ রমজানে রোজা রাখেন ও দিনশেষে ইফতার করেন। ধর্ম এক হলেও দেশে দেশে সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণে ইফতার আয়োজনেও থাকে ভিন্নতা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলমানদের ইফতার আয়োজনে রয়েছে বৈচিত্র্য।
যদিও প্রায় সব দেশেই সাধারণত খেজুর বা পানির মতো হালকা কিছু দিয়ে ইফতার শুরু হতে দেখা যায়, কিন্তু দেশে দেশে ইফতার আয়োজনে বাহারি পদের খাবার দেখা যায়।
পাকিস্তান
সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মুসলিম বসবাস করে পাকিস্তানে। ডব্লিউপিআর-এর তথ্য বলছে, দেশটির মোট জনসংখ্যার শতকরা ৯৮ ভাগের বেশি, অর্থাৎ ২৪ কোটি মানুষ মুসলিম।
পাকিস্তানে ইফতার আয়োজনে পানি ও খেজুরের পাশাপাশি মাংস ও রুটির মতো ঐতিহ্যবাহী খাবারও থাকে। নানা ধরনের কাবাব, তান্দুরি, কাটলেট ও টিক্কার সমন্বয় থাকে বড় অংশের পাকিস্তানিদের ইফতার আয়োজনে।
রোল, নিমকি, মাংস ও সবজি দিয়ে তৈরি করা এক ধরনের বিশেষ সমুচা, বিভিন্ন ধরনের চপ, পাকোড়া ইত্যাদির মতো বিভিন্ন ভাজাপোড়া খাবারও খেয়ে থাকেন তারা। নানারকম শরবত, ফল বা ফলের সালাদ, ছোলা-বুট, ফালুদা, জিলাপি, এমনকি বিরিয়ানি দিয়েও তাদের ইফতারের টেবিল সাজানো হয়। তবে পানীয় হিসেবে রুহ আফজার কদর এ দেশে সবচেয়ে বেশি।
ইন্দোনেশিয়া
ডব্লিউপিআর-এর তথ্য অনুযায়ী, ইন্দোনেশিয়ার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮৫ শতাংশ, অর্থাৎ দেশটির প্রায় সাড়ে ২৩ কোটি মানুষ মুসলিম। ইন্দোনেশিয়ানরা ইফতারে তেল ও মশলা জাতীয় খাবারের পরিবর্তে বিভিন্ন রকম ফল ও ফলের শরবতকে প্রাধান্য দেন। এছাড়া, তাদের ইফতার আয়োজনে নানা রকম মিষ্টি জাতীয় খাবারও থাকে।
ইন্দোনেশিয়ার সংবাদপত্র দ্য জাকার্তা পোস্ট-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বুবুর চ্যান্ডিল নামক এক ধরনের মিষ্টান্ন; মিষ্টি আলু দিয়ে তৈরি বিজি সালাক; কলা, মিষ্টি আলু অথবা কুমড়া দিয়ে তৈরি কোলাক; কলা দিয়ে তৈরি এস পিসাং ইজোসহ আরও নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবার এসময় ইন্দোনেশিয়ানরা তৈরি করে থাকে।
ভারত
জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে বর্তমানে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারত। দেশটির ১৪ শতাংশ, অর্থাৎ ২০ কোটি মানুষ হলো মুসলিম। তবে সংখ্যায় হিসেব করলে এটি মোটেও কম নয়। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদন বলছে, ভারতের হায়দ্রাবাদের মুসলিমরা ইফতারে হালিম খেতে পছন্দ করেন। আবার, কেরালা ও তামিলনাড়ুর মুসলমানরা ইফতার করেন ‘নমবু কাঞ্জি’ নামে এক ধরনের খাবার দিয়ে।
নমবু কাঞ্জি হলো মাংস, সবজি এবং পরিজের সমন্বয়ে তৈরি এক ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবার। তবে সামগ্রিকভাবে দেখলে ভারতেও ইফতারে ভাজাপোড়া জাতীয় খাবার খাওয়ার চল আছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের অলিতে-গলিতে ইফতারের আগে আগে নানা ধরনের পাকোড়া, সমুচা, চপ ইত্যাদি বিক্রির ধুম পড়ে যায়।
তবে দিল্লিসহ দেশটির উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে ইফতারের শুরুতে পানির সঙ্গে থাকে খেজুর, ছোলা-বুট, হরেক রকম ফল ও ফলের শরবত, দুধ, ডিম, দইয়ের মতো খাবার। ভারি খাবারের মাঝে থাকে বিভিন্ন ধরনের কাবাব, হালিম, কাটলেট, শর্মা, স্যুপ, বিরিয়ানি ইত্যাদি।
নাইজেরিয়া
ডব্লিউপিআরের তথ্য অনুযায়ী, সর্বোচ্চ মুসলিম জনগোষ্ঠী বসবাসের দিক থেকে শীর্ষ দশের মাঝে আছে পশ্চিম আফ্রিকান দেশ নাইজেরিয়াও। যদিও দেশটিতে মুসলিম আছে নয় কোটি ৭০ লাখ যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ৪২ শতাংশ।
নাইজেরিয়ার বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সেখানে ইফতারে শর্করা জাতীয় খাবার ও ফলমূলকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। যেমন- জল্লফ রাইস, এটি নাইজেরিয়ানদের অন্যতম প্রধান খাবার। চাল, পিঁয়াজ, টমেটো, মরিচ ইত্যাদির সমন্বয়ে এটি তৈরি করা হয়। এটি তারা সবজি বা মাংসের সঙ্গে খান।
পাশাপাশি মই মই (পুডিং), ইয়াম (এক ধরনের আলু), আকারা (বিন কেক), মাসা (রাইস কেক), ইলুবো ও আমালা’র (ইয়াম দিয়ে তৈরি এক বিশেষ খাবার) মতো আরও নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবারও তাদের ইফতার তালিকায় থাকে।
মিসর
মিসরের নয় কোটি মানুষ মুসলিম। দেশের মোট জনসংখ্যার হিসেবে মুসলিমরা প্রায় ৭৯ শতাংশ। দেশটিতে ইফতার মানেই একধরনের আনন্দ-উৎসব। মিসরীয় মুসলিমরা ইফতারের সময় মৃদু আলো দেয় এমন রঙ্গিন লণ্ঠন জ্বালিয়ে থাকেন। শুধু তাদের বাড়িতে নয়, পুরো রমজান জুড়ে সেখানকার পথেঘাটেও বিভিন্ন ধরনের রঙ্গিন আলো জ্বলতে দেখা যায়।
রমজানে তাদের ইফতার টেবিলে থাকে নানা ধরনের খাবারের সমারোহ। তার মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো ‘আতায়েফ’ ও ‘কুনাফা’। আতায়েফ হলো এক ধরনের প্যানকেক ও কুনাফা এক ধরনের সিরাপ। এই দুটো খাবার মিসরীয় মুসলমানদের ইফতারের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলা যেতে পারে। তবে দেশটির অনেক পরিবার ইফতারে বাদামি রুটি এবং মটরশুঁটি, টমেটো, বাদাম ও অলিভ অয়েল দিয়ে তৈরি ‘ফুল মেদেমাস’ নামক এক ধরনের খাবার খেতে পছন্দ করেন।
মিডল ইস্ট আইয়ের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, মিসরীয়রা তাদের ইফতারে এপ্রিকটস ফল দিয়ে তৈরি কামার-আল-দিনান্দ আরায়সি ও দুধ, ভ্যানিলা ও নারিকেল দিয়ে তৈরি সোবিয়া নামক পানীয় পান করেন। এছাড়া, তাদের খাবার টেবিলে বিভিন্ন ধরনের ফল, ফলের রস, সবজি ইত্যাদিও থাকে।
তুরস্ক
তুরস্কের ৯৮ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় আট কোটি মানুষ মুসলিম। দেশটির বিভিন্ন খাবার এখন শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এগুলো ‘টার্কিশ ফুড’ নামে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অন্যান্য মুসলিম দেশের মতো ইফতারের তাদেরও পছন্দের শীর্ষে থাকে খেজুর। সেইসাথে, বিভিন্ন ফলমূল, শরবত, হরেক রকম কাবাব তাদের খাদ্য তালিকায় থাকে।
তবে রমজানে দেশটির মুসলমানদের সবচেয়ে পছন্দের খাবার হলো রামাজান পিদেসি, যা মূলত এক ধরনের রুটি। এটি নান রুটির মতো একই পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়। প্রথমে ময়দার সঙ্গে দুধ, মাখন, জলপাই দিয়ে খামির তৈরি করা হয়। পরে রুটির ভেতর ডিম ও গরুর মাংসের পুর দিয়ে সেটিকে চুলায় বেক করা হয়।
ইরান
ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরান, যার ৯২ শতাংশ মানুষ (আট কোটি ২৫ লক্ষ) মানুষ মুসলিম। রুটি, স্যুপ, র্যাপ, কাবাবের মতো সুপরিচিত খাবারের পাশাপাশি ইফতারে ইরানের ঘরে ঘরে তৈরি হয় জাফরানের ঘ্রাণযুক্ত এক ধরনের ঐতিহ্যবাহী পার্শিয়ান হালুয়া।
এছাড়া, জাফরান চাল দিয়ে তৈরি ‘শোলেহ জার্দ’ নামক এক ধরনের পুডিংও ইরানিদের খুব প্রিয়। পার্শিয়ান নুডুলস, সবজি, পেঁয়াজ, বিন ইত্যাদি দিয়ে তৈরি আশ রাসতেহ নামক ঘন স্যুপ ও হালিমও সেখানে ইফতারের সময় আগ্রহ নিয়ে খাওয়া হয়। এছাড়াও তাদের ইফতারে আরও থাকে স্যান্ডউইচ, চা, তাবরেজি চিজ, জুলবিয়া (বাংলায় যাকে জিলাপি বলা হয়), বামিয়েহ নামক এক ধরনের মিষ্টান্ন ইত্যাদি।
আলজেরিয়া
উত্তর আফ্রিকার দেশ আলজেরিয়ার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯৫ শতাংশ মুসলিম। ডব্লিউপিআরের হিসেবে, দেশটিতে মাত্র সাড়ে চার কোটি মুসলিম বসবাস করে। জনসংখ্যার দিক থেকে শীর্ষ মুসলিম দেশগুলোর মাঝে এর অবস্থান দশম।
আলজেরিয়ান মুসলিমরা পিজ্জা ‘সোয়ারবা’, সবজি রোল, আলু, সবজি দিয়ে তৈরি দোলমা ইত্যাদি দিয়ে তাদের ইফতার শুরু করেন। মাগরিবের নামাজের পর তারা ‘সিগার’ নামক এক ধরনের পানীয় পান করেন, যা বাদাম দিয়ে তৈরি। এছাড়া, তাদের ইফতারের তালিকায় বিভিন্ন স্যুপও থাকে।
সৌদি আরব
মুসলিম দেশগুলো নিয়ে আলোচনা করলে সৌদি আরবের কথা না বললেই নয়। যদিও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক থেকে শীর্ষ দশে নেই দেশটি। ডব্লিউপিআর-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সৌদি আরবে মোট সোয়া তিন কোটি মুসলিম বসবাস করে, যা দেশটির মোট জনংখ্যার প্রায় ৮৫ শতাংশ।
আরব নিউজের এক প্রতিবেদন বলছে, সৌদিরা ইফতারের শুরুতে ‘গাহওয়া’ নামক অ্যারাবিক কফি পান করেন ও অবশ্যই খেজুর খান। এরপর তারা মাগরিবের নামাজ পড়েন। নামাজ শেষে তারা ভারী খাবার খান। সৌদি আরবেও অঞ্চলভেদে ইফতারের খাবারে ভিন্নতা রয়েছে। দেশটির পশ্চিম অঞ্চলের মানুষ তাদের ইফতারে শৌরাইক রুটি ও দুজ্ঞাহ নামক ঐতিহ্যবাহী খবার খান।
আবার, পূর্বাঞ্চলের লোকেরা ইফতারে সালুনা নামের একটি খাবার খান, যা মাংস ও সবজির স্টু দিয়ে তৈরি।
দেশটির কেন্দ্রীয় অঞ্চলের মানুষ তাদের রোজা ভাঙ্গেন আসিদাহ, মারগগ, মাফরৌক ও মাতাজিজ নামক ঐতিহ্যবাহী খাবার দিয়ে। এগুলো বাদামি আটা, গরুর মাংস, সবজি, মধু, পিঁয়াজ বা ঘি দিয়ে তৈরি করা হয়। দেশটির আরেকটি জনপ্রিয় খাবার থারিদ, যা মূলত ভেড়ার মাংস ও সবজি দিয়ে তৈরি স্যুপ জাতীয় খাবার।তথ্য সূত্র- বিবিসি