রবিবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৫, ০৭:১৪ অপরাহ্ন
বিডিসিলেট ডেস্ক : বর্ষা মৌসুমে হাওরের টানে সৌন্দর্যপিপাসু পর্যটক ও দর্শনার্থীদের আনাগোনা বাড়তে থাকায় সুনামগঞ্জের অর্থনীতিতে নতুন গতি এসেছে। এ সময় হাওরপাড়ের মানুষের প্রায় আয়ের সুযোগও বৃদ্ধি করছে। সুনামগঞ্জের আঁকাবাঁকা দৃষ্টিনন্দন নদী, হাওর, পাহাড় বিস্তৃত ৩ হাজার ৭৪৭ বর্গকিলোমিটারের জেলায় প্রায় ২৫ লাখ মানুষের বসবাস। সৌন্দর্যের টানে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর পর্যটকদের আগ্রহ কাড়ছে। আগে নৌকা ভাড়া নিয়ে সবাই হাওরে বেড়াতে যেত। সেখানে অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় তরুণদের আনাগোনাই ছিল বেশি। এখন পর্যটকদের কাছে নতুন আকর্ষণ হয়ে ধরা দিয়েছে হাউজবোট। দৃষ্টিনন্দন আধুনিক শহুরে সব সুবিধা থাকায় সকল বয়সি পর্যটকের কাছে ভালোই সাড়া ফেলেছে এসব হাউজবোট। বিশাল নৌকার ওপর খোলা ছাদে বসে হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ যেমন করা যায়, তেমনি নিচে নৌকায় একেবারে আধুনিক বেডরুম, কমোড, বাথরুম—যেন ভাসমান হোটেল। রয়েছে খাওয়া ও আড্ডা এবং নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর ব্যবস্থা। এসব কিছুর টানেই দিন দিন পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে সুনামগঞ্জে। তবে এই পর্যটকদের ভিড় হাওরের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের কারণও হয়ে উঠেছে।
সুনামগঞ্জ থেকে যে সব হাউজবোট ছাড়ে, তারা পর্যটকদের প্রথমে যাদুকাটা নদী, শিমুলবাগান, বারেকটিলার পর টাঙ্গুয়ার হাওর, ট্যাকেরঘাট, শহীদ সিরাজ লেক, লাকমাছড়া যায়। আবার অনেকে জেলা সদর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে তাহিরপুর উপজেলা বাজার ঘাট থেকে হাওর ভ্রমণে যায়। তাদের নিয়ে নৌকাগুলো প্রথমে টাঙ্গুয়ার হাওরের ওয়াচ টাওয়ার, পরে ট্যাকেরঘাট, শহীদ সিরাজ লেক, লাকমাছড়া ঘুরে দেখায়। এছাড়াও অনেকে শিমুলবাগান, শাহ আরেফিন (রা.) মাজার, বাঁশবাগান প্রভৃতি আকর্ষণীয় স্থানও ঘুরে দেখে।
সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর স্থানীয় লোকজনের কাছে নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল নামেও পরিচিত। প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি টাঙ্গুয়ার হাওর। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট, আর প্রথমটি হচ্ছে সুন্দরবন। ১৮টি মৌজায় ৫১টি হাওরের সমন্বয়ে ৯ হাজার ৭২৭ হেক্টর এলাকা নিয়ে হাওরটি জেলার সবচেয়ে বড় জলাভূমি। পানিবহুল মূল হাওর ২৮ বর্গকিলোমিটার, বাকি অংশ কৃষিজমি ও ৬৮টি গ্রামে রয়েছে মানুষের বসতি। ১৯৯৯ সালে সরকার এই এলাকাকে বিপন্ন প্রতিবেশ এলাকা ও ২০০০ সালে ইউনেসকো রামসার এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে। এই হাওর বিরল প্রজাতির মাছ ও অতিথি পাখির স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত। পৃথিবীব্যাপী অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন ২৬ প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল এ হাওরে।
তাহিরপুর উপজেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, টাঙ্গুয়ার হাওরে ২০১৯ সালে ২ লাখ পর্যটক আসে। ২০২০ সালে করোনা মহামারি থাকায় পর্যটক কমে যাওয়ার পরও লাখ খানেক পর্যটক আসে। ২০২১ সালে প্রায় সাড়ে তিন লাখ, ২০২২ সালে ৫ লাখ ও চলতি বছর ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ পর্যটক হাওর এলাকার পর্যটন স্পটগুলোতে এসেছে।
‘জলের গান’ হাউজবোটের মালিক তরুণ উদ্যোক্তা নিজাম উদ্দিন জানান, ২০১৭ সাল থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকদের ভ্রমণ ব্যবসার সঙ্গে নিয়োজিত রয়েছেন। আগে স্থানীয়দের ছোট নৌকা ভাড়া নিয়ে পর্যটকদের দিতাম, এখন নিজের ছোট-বড় দুটি হাউজবোট রয়েছে। তিনি জানান, এখানকার পর্যটনশিল্প নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা করলে দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটক আসবে, এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। কয়েক বছরের মধ্যেই হাওরের অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন আসবে।
টাঙ্গুয়ার হাওরে শতাধিক হাউজবোট চলে। তার মধ্যে মেঘদূত, বনেদি, টাঙ্গুয়ার বিলাস, জলপদ্ম, জলকন্যা, সেডপ টাঙ্গুয়া, জলযাত্রা, চন্দ্রভ্রমণ, জলস্বপ্ন, জান্নাত নৌ-পরিবহন, পানসী হাউজ, চাঁদের বাড়ি, রাজার তরী, জলের ঘর, আরশিনগর, আনন্দ তরি, বর্ষা, জলতরঙ্গ অন্যতম। এসব হাউজবোটের প্রতিটিতেই আছে এটাচড বাথরুম। এছাড়া আছে আরো চারটি ওপেন কেবিন। যার দুটিতে চার জন করে, আর অন্য দুটিতে তিন জন করে বেশ আরামেই থাকা সম্ভব। আছে দুটি বড়সড় ও পরিচ্ছন্ন ওয়াশ রুম।
তবে বর্ষায় নিয়ন্ত্রণহীনভাবে টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটক ও তাদের পরিবহনকারী নৌকা ও হাউজবোটের অবাধে চলাচলে হাওরের প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী বলেন, সুনামগঞ্জে অনেক পর্যটন এলাকা রয়েছে। এরমধ্যে টাঙ্গুয়ার হাওর, শহীদ সিরাজ লেক (নিলাদ্রী), যাদুকাটা, বড়গোপটিলা ও দেশের সবচেয়ে বড় শিমুলবাগান রয়েছে। এখন পর্যটনের মৌসুম। প্রতিদিন অনেক পর্যটক আসছে। তাদের নীতিমালা মেনে ভ্রমণ করার জন্য বলা হয়েছে। নীতিমালা না মানলে পুরো পর্যটন খাতই হুমকির মধ্যে পড়বে। এজন্য ট্যুর অপারেটরদেরও আরো সচেতন হতে হবে।
সরেজমিনে টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরে দেখা যায়, প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার পর্যটক আসে তাহিরপুর, মধ্যনগর ও সুনামগঞ্জ জেলায়। এরপর তারা নৌকা ও হাউজবোটে করেই আসছে হাওরে। তারা হাওরে আসার পথেই উচ্চ শব্দের সাউন্ড বক্স বাজিয়ে নেচে-গেয়ে হাওরে প্রবেশ করছে।
তাহিরপুর নৌচালক মালিক সমিতির সভাপতি শাহীনুর তালুকদার বলেন, ‘আমরা স্থানীয়রা নিয়মনীতি অনুসরণ করে চলাচল করলেও বাইরের নৌকা ও হাউজবোট নিয়ন্ত্রণহীনভাবে হাওরে চলাচল ও বিভিন্ন প্লাস্টিকের পণ্য পানিতে ফেলছে।’