শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:২৭ অপরাহ্ন
মস্তকবিহীন বিবস্ত্র ক্ষতবিক্ষত মরদেহের মাথা ও শরীর আলাদা করে ফেলা হয় পৃথক জমিতে। ক্লুলেস অবস্থায় উদ্ধার করা মরদেহটি ১০ বছরের স্কুলছাত্রী ইভা বেগমের। নিহত ইভা (১০) সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার দোলারবাজার ইউনিয়নের দক্ষিণ কুর্শী গ্রামের মোশাহিদ আলীর মেয়ে। অবশেষে জানা গেল ইভার খুনি আর কেউ নয়, তার আপন ভাই রবিউল হাসান (১৯)।
যে ভাইয়ের কাছে বোনের নিরাপদ আশ্রয় হওয়ার কথা, উপরন্তু হত্যা মামলা জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে বাদীকে ফাঁসাতে পরিকল্পিতভাবে সঙ্গীদের নিয়ে আপন বোনকে খুন করলেন রবিউল।
গত বুধবার (৪ অক্টোবর) সুনামগঞ্জের ছাতকে দক্ষিণ কুর্শি গ্রামের আতাউর রহমানের ধান ক্ষেতে থেকে স্কুলছাত্রী ইভার মস্তকবিহীন বিবস্ত্র মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তার বিচ্ছিন্ন মাথা উদ্ধার করা হয় গ্রামের আহমদ আলী লিটনদের জমি থেকে।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বাবা মোশাহিদ আলীকে সঙ্গে নিয়ে থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশের সন্দেহ হয় রবিউল হাসানকে। তাকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে আপন বোনকে নৃশংসভাবে হত্যার কথা স্বীকার করেন রবিউল। ফলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ক্লুলেস এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করতে সক্ষম হয় পুলিশ।
আপন বোন ইভাকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন রবিউল হাসান।
শনিবার (০৭ অক্টোবর) বিকেলে সুনামগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ইসরাত জাহান ১৬৪ ধারায় তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন। জবানবন্দিতে নিজের বোনকে গলা কেটে হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দেয় রবিউল।
আদালতে রবিউলের ১৬৪ ধারা জবানবন্দির বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, ২০২২ সালের ৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার দোলারবাজার ইউনিয়নের উত্তর কুর্শী গ্রামের খালেদ নূরকে হত্যা করা হয়। ওই হত্যা মামলায় প্রধান আসামি রবিউল হাসান। এ মামলায় রবিউল ও তার মা কারাভোগ করেন। ১১ মাস কারাভোগের পর একমাস আগে উচ্চ আদালতের জামিনে বেরিয়ে আসেন। এক বছর পর একই দিনে এবং একই সময়ে মামলার বাদীদের ফাঁসাতে সহযোগীদের নিয়ে নিজের বোন ইভাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে সে। আর এই হত্যার পরিকল্পনা করে কারাগারে বসেই।
কারাগারে থাকাবস্থায় প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে নিজের বোনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন রবিউল। এক মাস আগে ওই মামলায় উচ্চ আদালত থেকে তিনি জামিনে বেরিয়ে এসে নিজের স্কুল পড়ুয়া বোনকে খুন করে প্রতিপক্ষকে আসামি করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে।
ইভা দক্ষিণ কুর্শী পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী ছিল। গত ৪ অক্টোবর স্কুল ছুটি শেষে বাড়ি ফিরে ইভা। ওইদিন সন্ধ্যার আগে তার বোনকে গ্রামের একটি দোকানে মজা খাওয়ার জন্য ১০ টাকা দিয়ে মোবাইলের একটি মিনিট কার্ড আনার জন্য আরও ২০ টাকা দিয়ে পাঠায় রবিউল। বোনকে দোকানে পাঠিয়ে সহযোগীসহ রবিউল রাস্তায় অপেক্ষার প্রহর গোনে।
মাগরিবের আযানের পর দোকান থেকে মজা ও মোবাইল মিনিট কার্ড নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় রাস্তায় ইভাকে আটক করে গ্রামের একটি বাড়ির খড়ের ঘরে নিয়ে যায় তারা। হাত মুখসহ সমস্ত শরীর চেপে ধরে গলায় রামদা দিয়ে ইভার মস্তক দ্বি-খণ্ডিত করা হয়। দেহ থেকে মস্তক আলাদা করেই ক্ষান্ত নয় ঘাতক দল, মৃত্যু নিশ্চিত করার পরও ইভার উরুসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছুরিকাঘাত করা হয়। পরে দেহটি বিবস্ত্র অবস্থায় গ্রামের আতাউর রহমানের ধান ক্ষেতে আর মস্তক আহমদ আলী লিটনদের জমিতে ফেলে রাখা হয়।
এ ঘটনার আগে বোন দোকান থেকে আর বাড়ি না ফেরায় তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে নাটক সাজায় রবিউল। ধরা পড়ার পর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এমন লোমহর্ষক বর্ণনা দেয় রবিউল।
আদালতে দীর্ঘ সময় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণের পর বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেন।
গত ৪ অক্টোবর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ইভার মস্তক বিহীন দেহটি ধান ক্ষেত থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। যাতে ধারণা করা হয়, দুর্বৃত্তরা পাশবিক নির্যাতনের পর তাকে হত্যা করেছে। পরদিন ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহটি সুনামগঞ্জে মর্গে পাঠায় এবং ওইদিন ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে মস্তকবিহীন দেহটি হস্তান্তর করে পুলিশ। তাছাড়া মস্তক উদ্ধারে পুলিশ অভিযান অব্যাহত রাখে। মরদেহ দাফন শেষে বাবা-ছেলে মামলা করতে থানায় গেলে রবিউলকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে তার দেখানো মতে গত শুক্রবার রাত ৮টার দিকে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে মস্তকটি উদ্ধার করে। শনিবার ওই মস্তকটি ময়নাতদন্তের জন্য সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে পাঠায় পুলিশ।
ক্লু-লেস মামলার লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) আবু সাঈদ, সহকারী পুলিশ সুপার (ছাতক সার্কেল) রণজয় চন্দ্র মল্লিক, ছাতক থানার (ওসি) তদন্ত আরিফুল আলম।
সহকারী পুলিশ সুপার (ছাতক সার্কেল) রণজয় চন্দ্র মল্লিক ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।