রবিবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৫, ১০:২৯ পূর্বাহ্ন

শিরোনাম ::
মাদক ব্যবসার অভিযোগে স্বামী-স্ত্রী গ্রেফতার আজহারীর মাহফিল থেকে ফেরার পথে শিক্ষার্থীর মৃত্যু সুনামগঞ্জে ১৯জন হাফেজকে সংবর্ধনা আজহারীর মাহফিলের আগেই কানায় কানায় পূর্ণ মাঠ সৌদি আরবে ২১ হাজার প্রবাসী গ্রেফতার যেসব গুণ থাকলে আল্লাহর প্রিয় হওয়া যায় দুই তারকা ছাড়াই চ্যাম্পিয়নস ট্রফির দল ঘোষণা ভারতের ঠান্ডা, সর্দি-কাশির উপশমে খেতে পারেন যেসব খাবার প্রথম পর্বে ৭৩৫ ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেবে ইসরায়েল বাংলাদেশে ঢুকে গাছের ডাল কাটল বিএসএফ সুনামগঞ্জে সীমান্তজুড়ে কঠোর অবস্থানে বিজিবি সিলেটে সীমান্তে ভারতীয় চোরাই পণ্য জব্দ হবিগঞ্জে সীমান্ত এলাকায় সাড়ে ৭ কোটি টাকার মাদক ধ্বংস নেপালকে হারিয়ে বিশ্বকাপে উড়ন্ত সূচনা বাংলাদেশের লাউয়াছড়ায় পর্যটকের ভিড়ে অস্বস্তিতে বন্য প্রাণী




গুলি তো আমার কলিজাটাই ছিদ্র করে দিয়েছে, জীবনের ছন্দ কেটে গেছে

PHOTO1 - BD Sylhet News




বিডিসিলেট ডেস্ক : ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী শাসনামলের অবসানের মধ্যদিয়ে ‘নতুন বাংলাদেশের’ সূর্যোদয় হয়। এরপর প্রায় ৫ মাস কেটে গেলেও গণঅভ্যুত্থানে শহিদদের পরিবারে স্বজন হারানোর ব্যথা এখনো ‘দগদগে’। প্রিয়জনের এমন অপ্রত্যাশিত বিদায়ে পরিবারগুলো এখনো শোকে স্তব্ধ।

নতুন বাংলাদেশের প্রত্যাশায় গত ৫ আগস্ট মাকে চিঠি লিখে ঘর থেকে বেরিয়ে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল ১৬ বছর ৯ মাস বয়সী কিশোর শাহারিয়ার খাঁন আনাস। গেন্ডারিয়া আদর্শ একাডেমির দশম শ্রেণিপড়ুয়া আনাস সেদিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায়। তার মৃত্যুর পর মাকে লিখে যাওয়া চিঠিটি ভাইরালও হয়েছিল। তবে এবার ছেলের স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন আনাসের মা সানজিদা খান।

ছেলে হারানোর শোকে স্তব্ধ সানজিদা খান গণমাধ্যমে লিখেছেন, যে মা তার সন্তান হারায়, তিনি তো সেদিনই মরে যান। শুধু সন্তানের সঙ্গে দেখা করার অপেক্ষা আর দীর্ঘনিশ্বাস বেঁচে থাকে। তোকে ছাড়া আমি ভালো নেই বাপ। তোকে ছাড়া আজ ১৪৯তম দিন..এভাবেই হিসাব কষি প্রতিনিয়ত।

আনাসের মা লিখেছেন, মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে অটোরিকশায় তোর গুলিবিদ্ধ লাশ কোলে করে বাসায় আনি। গত ৫ আগস্ট বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ১৬ বছর ৯ মাস বয়সী আমার ছেলেটাকে পুলিশ গুলি করে। বুকের বাঁ পাশে গুলি লেগেছিল। সেই গুলি তো আমার কলিজাটাই ছিদ্র করে দিয়েছে। আমার জীবনের ছন্দ কেটে গেছে। বেঁচে থাকার আকুতি শেষ হয়ে গেছে।

ছেলের স্মৃতিচারণ করে সানজিদা খান আরও লিখেছেন, আনাস, তুই চলে যাওয়ার পর দুই মাস তো বিছানা থেকেই নড়তে পারিনি। কিন্তু জীবনের তাগিদে বাঁচতে হচ্ছে। বাইরে থেকে আগে তুই সকালের নাশতা কিনে আনতি, এখন আমি আনি। তুই স্কুল থেকে ফিরবি, তাই দুপুরে আয়োজন করে রান্না করে তোর অপেক্ষা করতাম। এখন আমার কারও জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। তুই ফিরলে মা-ছেলে দুজন দুপুরের খাবার খেতাম আর গল্প করতাম। এখন একটা প্লেটে (থালা) ভাত নিই, তোর ছোট দুই ভাইকে খাইয়ে কোনোদিন নিজে দু-নলা মুখে দিই। আবার কোনো দিন কিছুই খেতে ইচ্ছে করে না। তুই প্রতিটা মুহূর্ত আমাকে কষ্ট দিচ্ছিস।

দশম শ্রেণিপড়ুয়া আনাসের মা এখনো ঘরের প্রতিটি কোনায় ছেলের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান। লিখেছেন, অস্থিরতা পেয়ে বসলে তোর কবরে ছুটে যাই, কত কথা বলি তোর সঙ্গে। তখন মনটা একটু হালকা হয়। যে দেশটাকে ভালোবাসলি, সেই দেশ তো তোর নিরাপত্তা দিতে পারল না।

ছেলের জন্মদিনের স্মৃতিচারণ করে সানজিদা খান লিখেছেন, যেদিন তোর জন্ম হয়েছিল, সে দিনটা ছিল ঈদের (পবিত্র ঈদুল ফিতর) দিন। তখন আমার বয়স মাত্র ১৮ বছর পার হয়েছে। আমরা তো শুধু মা-ছেলে ছিলাম না, ছিলাম দুই বন্ধু। আমরা তো বলতে গেলে একসঙ্গেই বড় হচ্ছিলাম। তুই আমার প্রথম সন্তান, সে এক অন্য রকম অনুভূতি। প্রয়োজন নেই, তারপরও তোর জন্য কত ‘ফিডার’ যে কিনেছিলাম। তুই চলেও গেলি আরেক বিজয়ের দিনে, যেদিন (৫ আগস্ট) শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর সবাই আনন্দ-উল্লাস করছিল। আমরা তখন তোর রক্তাক্ত লাশ নিয়ে দৌড়াচ্ছি।

চিঠি লিখে ঘর থেকে বেরিয়ে ছেলের আন্দোলনে যাওয়ার কথা তুলে ধরে আনাসের মা লিখেছেন, তুই মায়ের ভালো লাগাকে সবসময় গুরুত্ব দিতি। তাড়াহুড়ো করে বাইরে চলে গেলে এসে দেখতাম ঘরটা তুই গুছিয়ে রেখেছিস। তুই জানতি মা এলোমেলো ঘর পছন্দ করে না। মারা যাওয়ার আগে নিজের কাজ নিজে করতিস মায়ের কষ্ট কমানোর জন্য। সেদিনও (৫ আগস্ট) ঘর থেকে বের হওয়ার আগে চিঠি লিখে গিয়েছিলি। লিখেছিলি, ‘মা আমি মিছিলে যাচ্ছি। আমি নিজেকে আর আটকিয়ে রাখতে পারলাম না। সরি আব্বুজান। তোমার কথা অমান্য করে বের হোলাম। স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে থাকতে পারলাম না..।’

সানজিদা খান আরও লিখেছেন, আনাস বাবা, এ বছর শীতে তোকে হুডি (শীতের পোশাক) কিনে দিতে চেয়েছিলাম। মাকে তো একবারও বললি না, ‘মা হুডি কিনে দাও’। তোর শীত লাগে না? শীতের রাতে তোর গায়ে কম্বল জড়িয়ে দেয়ার মুহূর্তটা তো আর আসে না। তোকে ছাড়া আমরা একা হয়ে গেছি। রাতে তোর বাবা বাইরে গেলে বলতে পারি না আনাসকে নিয়ে যাও। আমি একলা বাসায় থাকলে তোর বাবা বলতে পারে না, আনাস মায়ের সঙ্গে থাকো। আসলে তোকে ছাড়া আমাদের যে কষ্ট, তা কেউ কখনোই বুঝতে পারবে না।

ছেলের ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্নের আক্ষেপও এখনো সানজিদা খানের স্মৃতিতে তরতাজা। লিখেছেন, তুই ভবিষ্যতে ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছিলি। গুলিতে মারা না গেলে তুইও অন্যদের সঙ্গে পরীক্ষা দিতি। তোর স্কুলের শিক্ষকেরা তোর সিটে (আসন) দুটো গোলাপ আর তোর বীরত্বের কথা লিখে রেখেছিলেন। মাঝে মাঝে ভাবি বুলেটের কাছে তুই হার মেনেছিস। তবে পরে আবার ভাবি বুলেট বুকে নিয়ে তুই তো পুরো দেশটাকেই জিতিয়ে দিয়ে গেছিস।

আনাসের মা লিখেছেন, জুরাইন কবরস্থানে তুই এখন তোর দাদির কবরে শুয়ে আছিস। গত বছর তোর দাদি মারা যাওয়ার কারণে তোর জন্মদিনে কেক আনা হয়নি। এবার তো কেক আনতে চেয়েছিলাম, তোর পছন্দের খাবার রান্না করতে চেয়েছিলাম, কিছুই করা হলো না। দেশকে ভালোবেসে মাকে এতটা না কাঁদালেও পারতি বাপ।

আন্দোলনের সময়ের স্মৃতিচারণ করে সানজিদা খান লিখেছেন, ঘরে বসে তুই আর আমি স্লোগান দিতাম ‘রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়’। সেই রক্তে আমার ছেলের রক্তও থাকবে, তা তো বুঝিনি। তোর মুখ থেকে কত দিন মা ডাক শুনি না, কত দিন তোকে দেখি না, মনে হয় পৃথিবীতে তোকে ছাড়া একদিন একদিন করে সাজা ভোগ করছি। তুই তো চিঠিতে লিখেছিলি, ‘একদিন তো মরতে হবেই। তাই মৃত্যুর ভয় কোরে স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে না থেকে সংগ্রামে নেমে গুলি খেয়ে বীরের মতো মৃত্যুও অধিক শ্রেয়। যে অন্যের জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেয়, সেই প্রকৃত মানুষ। আমি যদি বেঁচে না ফিরি, তবে কষ্ট না পেয়ে গর্বিত হয়ো।’

শহিদ আনাসকে নিয়ে নিজের গর্বের কথা জানিয়ে সানজিদা লিখেছেন, তোর জন্য আমার খুব গর্ব হয়। আমরা যা করতে সাহস পাইনি, তুই তা-ই করেছিস। যেখানে আছিস, সেখানে শুধু তুই ভালো থাকিস। হয়তো আবার একদিন আমাদের দেখা হবে, আবার আমরা ভালো বন্ধু হব।

আনাসের মা আরও লিখেছেন, আমাকে শহিদের মা হিসেবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আয়োজকেরা ডেকে নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে শুনি ‘আনাস, সাঈদ, মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’। যুদ্ধটা এবার শেষ হোক। আনাস, তোকে ছাড়া নতুন বছর শুরু হচ্ছে। যে বছরে আমার ছেলের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না, সে বছর নিয়ে আমার কোনো ভাবনা নেই, পরিকল্পনা নেই। তারপরও তুই ও তোদের মতো যে সন্তানদের রক্তে নতুন বাংলাদেশ পেলাম, সে বাংলাদেশটা ভালো থাকুক, তা-ই চাই।

লেখা: সানজিদা খান, শহিদ আনাসের মা।

শেয়ার করুন...











বিডি সিলেট নিউজ মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। © ২০২৪
Design & Developed BY Cloud Service BD